পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(8 রবীন্দ্র-রচনাবলী এই অবজ্ঞার দ্বারা আমরা নিজেকেই বঞ্চিত করি। যাকে আমরা বড়ো করে পেতুম তাকে ছোটো করে পাই, যাতে আমাদের চিত্তও পরিতৃপ্ত হত তাতে আমাদের কেবল পেট ভরে মাত্র। যারা জল স্থল বাতাসকে কেবল প্রতিদিনের ব্যবহারের দ্বারা জীর্ণ সংকীর্ণ করে দেখেন নি, যারা নিত্য নবীন দৃষ্টি ও উজ্জ্বল জাগ্ৰত চৈতনের দ্বারা বিশ্বকে অন্তরের মধ্যে সমাদৃত অতিথির মতো গ্ৰহণ করেছেন এবং চরাচর সংসারের মাঝখানে জোড়হন্তে দাঁড়িয়ে উঠে বলেছেন— যো দেবোহন্ত্রেী যোহপসু যে বিশ্বং ভূবনমাবিবেশ য, ওষধিযু যে বনস্পতিযু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ।। তাদের উচ্চারিত এই সজীব মন্ত্রটিকে জীবনের মধ্যে গ্ৰহণ করে ঈশ্বর যে সর্বব্যাপী এই জ্ঞানকে সর্বত্র সার্থক করে । যিনি সর্বত্র প্রত্যক্ষ, তার প্রতি তোমার ভক্তি সর্বত্র উচ্ছসিত হয়ে উঠুক। বোধশক্তিকে আর অলস রেখে না, দৃষ্টির পশ্চাতে সমস্ত চিত্তকে প্রেরণ করো। দক্ষিণে বামে অধোতে উর্ধে, সম্মুখে পশ্চাতে চেতনার দ্বারা চেতনার স্পৰ্শলাভ করো। তোমার মধ্যে অহােরাত্র যে, ধীশক্তি বিকীর্ণ হচ্ছে, সেই ধীশক্তি যোগে ভুরিভুবঃম্বর্লোকে সর্বব্যাপী ধীকে ধ্যান করো।— নিজের তুচ্ছতা-দ্বারা অগ্নি জলকে তুচ্ছ কোরো না । সমস্তই আশ্চর্য, সমস্তই পরিপূর্ণ। নমোনমঃ, নমোনমঃ– সর্বত্রই মাথা নত হােক, হৃদয় নম্র হােক এবং আত্মীয়তা প্রসারিত হয়ে যাক। যাকে বিনামূল্যে পেয়েছি তাকে সচেতন সাধনার মূল্যে লাভ করে, যে অজস্র অক্ষয় সম্পদ বাহিরে রয়েছে তাকে অন্তরে গ্রহণ </ निों ३७ | য ওষধিযু যো বনস্পত্তিষু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ। পূর্বছত্ৰে আছে যিনি অগ্নিতে, জলে, খিনি বিশ্বভুবনে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন— তারপরে আছে যিনি ওষধিতে বনস্পতিতে তাকে বার বার নমস্কার করি । হঠাৎ মনে হতে পারে প্রথম ছত্রেই কথাটা নিঃশেষ হয়ে গেছে- তিনি বিশ্বভুবনেই আছেন। তবে কেন শেষের দিকে কথাটাকে এত ছোটাে করে ওষধি বনস্পতির নাম করা হল ! বস্তুত মানুষের কাছে এইটেই শেষের কথা । ঈশ্বর বিশ্বভুবনে আছেন এ কথা বলা শক্ত নয় এবং আমরা অনায়াসেই বলে থাকি, এ কথা বলতে গেলে আমাদের উপলব্ধিকে অত্যন্ত সত্য করে তোলার প্রয়োজন হয় না । কিন্তু তার পরেও যে-ঋষি বলেছেন তিনি এই ওষধিতে এই বনস্পতিতে আছেন, সে-ঋষি মন্ত্রদ্রষ্টা । মন্ত্রকে তিনি কেবল মননের দ্বারা পান নি, দর্শনের দ্বারা পেয়েছেন। তিনি তীর তপোবনের তরুলতার মধ্যে কেমন পরিপূর্ণ চেতনভাবে ছিলেন, তিনি যে নদীর জলে স্নান করতেন সে স্নান কী পবিত্র স্নান, কী সত্য স্নান, তিনি যে-ফল ভক্ষণ করেছিলেন তার স্বাদের মধ্যে কী অমৃতের স্বাদ ছিল, তার চক্ষে প্রভাতের সূর্যোদয় কী গভীর গভীর কী অপরূপ প্রাণময় চৈতন্যময় সূর্যোদয়সে কথা মনে করলে হৃদয় পুলকিত হয়। তিনি বিশ্বভুবনে আছেন এ কথা বলে তাকে সহজে বিদায় করে দিলে চলবে না— কবে বলতে পারব। তিনি এই ওষধিতে আছেন, এই বনম্পতিতে আছেন । ( A