পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

や〉の রবীন্দ্র-রচনাবলী পরব্রহ্মের প্রতি আমরা যা-কিছু বিশেষণ প্রয়োগ করি সে কেবল কতকগুলি কথা মাত্র, আমাদের কাছে তার কোনো অর্থই নেই । তা যদি হয় তবে এই ব্ৰহ্মের কথাটাকে একেবারেই ত্যাগ করতে হয় | র্যাকে কোনোকালেই পাব না তঁাকে অনন্তকাল খোজার মতো বিড়ম্বনা আর কী আছে ? তা হলে এই কথাই বলতে হয় সংসারকেই পাওয়া যায়, সংসারই আমার আপনার, ব্ৰহ্মা আমার কেউ নন । কিন্তু সংসারকে তো পাওয়া যায় না। সংসার তো মায়ামৃগের মতো আমাদের কেবলই এগিয়ে নিয়ে দৌড় করায়, শেষ ধরা তো দেয় না। কেবলই খাটিয়ে মারে, ছুটি দেয় না— ছুটি যদি দেয় তো একেবারে বরখাস্ত করে । এমন কোনো সম্বন্ধ স্বীকার করে না যা চরম সম্বন্ধ । শ্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ানের সঙ্গে ঘোড়ার যে সম্বন্ধ তার সঙ্গে আমাদেরও সেই সম্বন্ধ। অর্থাৎ, সে কেবলই আমাদের চালাবে, খাওয়াবে সেও চালাবার জন্যে, মাঝে মাঝে যেটুকু বিশ্রাম করাবে সেও কেবল চালাবার জন্যে, চাবুক লাগাম সমস্তই চালাবার উপকরণ। যখন না চলব। তখন খাওয়াবে না, আস্তাবলেও রাখবে না, ভাগাড়ে ফেলে দেবে। অথচ এই চালাবার ফল ঘোড়া পায় না । ঘোড়া স্পষ্ট করে জানেও না সে ফল কে পাচ্ছে। ঘোড়া কেবল জানে যে তাকে চলতেই হবে ; সে মূঢ়ের মতো কেবলই নিজেকে প্রশ্ন করছে, “কোনো কিছুই পাচ্ছি নে, কোথাও গিয়ে পৌঁচচ্ছি নে, তবু দিনরাত কেবলই চলছি কেন ? পেটের মধ্যে অগ্নিময় ক্ষুধার চাবুক পড়ছে, হৃদয় মনের মধ্যে কত শত জ্বালাময় ক্ষুধার চাবুক পড়ছে, কোথাও স্থির থাকতে দিচ্ছে না। এর অর্থ কী ? যাই হােক, কথা হচ্ছে এই যে, সংসারকে তো কোনোখানেই পাচ্ছি নে, তার কোনোখানে এসেই থামছি নে- ব্ৰহ্মও কি সেই সংসারেরই মতো ? তাকেও কি কোনোখানেই পাওয়া যাবে না ? তিনিও কি আমাদের অনন্তকালই চালাবেন এবং সেই পাওয়াহীন চলাকেই অনন্ত উন্নতি বলে আমরা নিজের মনকে কেবলই কোনোমতে সান্তনা দিতে চেষ্টা করব ? তা নয়, ব্ৰহ্মকেই পাওয়া যায়, সংসারকে পাওয়া যায় না । কারণ, সংসারের মধ্যে পাওয়ার তত্ত্ব নেই— সংসারের তত্ত্বই হচ্ছে সরে যাওয়া, সুতরাং তাকেই চরমভাবে পাবার চেষ্টা করলে কেবল দুঃখই পাওয়া হবে । কিন্তু ব্ৰহ্মকেও চরমভাবে পাবার চেষ্টা করলে কেবল চেষ্টাই সার হবে। এ কথা বলা কোনােমতেই চলবে না। পাওয়ার তত্ত্ব কেবল একমাত্র ব্রহ্মেই আছে। কেননা, তিনিই হচ্ছেন সত্য । আমাদের অন্তরাত্মার মধ্যে পরমাত্মাকে পাওয়া পরিসমাপ্ত হয়ে আছে । আমরা যেমন যেমন বুদ্ধিতে হৃদয়ে উপলব্ধি করছি তেমনি তেমনি তাকে পাচ্ছি- এ হতেই পারে না। অর্থাৎ যেটা ছিল না সেইটেকে আমরা গড়ে তুলছি, তার সঙ্গে সম্বন্ধটা আমাদের নিজের এই ক্ষুদ্র হৃদয় ও বুদ্ধির দ্বারা সৃষ্টি করছি, এ ঠিক নয়। এই সম্বন্ধ যদি আমাদেরই দ্বারা গড়া হয় তবে তার উপরে আস্থা রাখা চলে না, তবে সে আমাদের আশ্রয় দিতে পারবে না । আমাদের মধ্যেই একটি নিত্যধাম আছে । সেখানে দেশকালের রাজত্ব নয়, সেখানে ক্রমশ সৃষ্টির পালা নেই। সেই অন্তরাত্মার নিত্যধামে পরমাত্মার পূর্ণ আবির্ভাব পরিসমাপ্ত হয়েই আছে। তাই উপনিষৎ বলছেন সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্ম যে বেদ নিহিতং গুহায়াং পরমে বোমন সোহঙ্গুতে সর্বান কামান, সহ ব্ৰহ্মাণ বিপশ্চিতা । সকলের চেয়ে শ্ৰেষ্ঠ ব্যোম, যে পরম ব্যোম, যে চিদাকাশ, অন্তরাকাশ, সেইখানে আত্মার মধ্যে যিনি সত্যজ্ঞান ও অনন্তস্বরূপ পরব্রহ্মকে গভীরভাবে অবস্থিত জানেন, তার সমস্ত বাসনা পরিপূর্ণ হয় । ব্ৰহ্ম কোনো একটি অনিৰ্দেশ্য অনন্তের মধ্যে পরিপূর্ণ হয়ে আছেন, এ কথা বলবার কোনো মানে নেই। তিনি আমাদেরই অন্তরাকাশে আমাদেরই অন্তরাত্মায় সত্যং জ্ঞানমনস্তং রূপে সুগভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত আছেন, এইটি ঠিকমত জানলে বাসনায় আমাদের আর বৃথা ঘুরিয়ে মারে না--- পরিপূর্ণতার উপলব্ধিতে আমরা স্থির হতে পারি।