পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন \ኃS % তখন হয়তাে নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, কী করতে এসেছিলুম, কেনই বা টিকিটের দাম দিলুম, এই থাম চৌকির অর্থ কী, এতগুলো লোকই বা এখানে জড় হয়েছে কী করতে ? সমস্তই ফাকি, সমস্তই অর্থহীন ছেলেখেলা । হায়, আনন্দের অভিনয় যে নাট্যমঞ্চে হচ্ছে সে দিকের কোনো খবরই পাওয়া গেল না। জীবনের আনন্দলীলা যিনি করছেন তিনি যে এই ভিতরে বসেই করছেন— ঐ থাম চৌকিগুলো যে বহিরঙ্গ মাত্র। ঐগুলিই প্রধান সামগ্ৰী নয়। একবার অন্তরের দিকে চােখ ফেরাও— তখনই সমস্ত মানে বুঝতে পারবে । যে কাণ্ডটা হচ্ছে সমস্তই যে অন্তরে হচ্ছে। এই যে অন্ধকার কেটে গিয়ে এখনই ধীরে ধীরে সূর্যোদয় হচ্ছে একি কেবলই তােমার বাইরে ? বাইরেই যদি হত। তবে তুমি সেখানে কোন দিক দিয়ে প্রবেশ করতে ? বিশ্বকর্ম যে তোমার চৈতন্যাকাশকে এই মুহূর্তে একেবারে অরুণরাগে প্লাবিত করে দিলেন। চেয়ে দেখাে তোমারই অন্তরে তরুণ সূর্য সোনার পদ্মের কুঁড়ির মতো মাথা তুলে উঠছে, একটু একটু করে জ্যোতির পাপড়ি চারি দিকে ছড়িয়ে দেবার উপক্রম করছে— তোমারই অন্তরে । এই তো বিশ্বকর্মর আনন্দ । তোমারই এই জীবনের জমিতে তিনি এত সোনার সুতো রুপাের সুতো এত রঙ-বেরঙের সুতো দিয়ে অহরহ এতবড়ো একটা আশ্চর্য বুনানি বুনছেন- এ যে তোমার ভিতরেই- যা একেবারে বাইরে সে যে তোমার নয় । তবে এখনই দেখো । এই প্ৰভাতকে তোমারই অন্তরের প্রভাত বলে দেখো, তোমারই চৈতন্যের মধ্যে তার আনন্দ-সৃষ্টি বলে দেখো । এ আর কারও নয়, এ আর কোথাও নেই- তোমার এই প্রভাতটি একমাত্র তোমারই মধ্যে রয়েছে এবং সেখানে একলামাত্র তিনিই রয়েছেন । তোমার এই সুগভীর নির্জনতার মধ্যে তোমার এই অন্তহীন চিদাকাশের মধ্যে তার এই অদ্ভুত বিরাট লীলা।— দিনে রাত্রে অবিশ্রাম । এই আশ্চর্য প্ৰভাতের দিকে পিঠ ফিরিয়ে একে কেবলই বাইরের দিকে দেখতে গেলে এতে আনন্দ পাবে না, অর্থ পাবে না । যখন আমি ইংলন্ডে ছিলুম। আমি তখন বালক । লন্ডন থেকে কিছু দূরে এক জায়গায় আমার নিমন্ত্রণ ছিল। আমি সন্ধ্যার সময় রেলগাড়িতে চড়লুম। তখন শীতকাল। সেদিন কুহেলিকায় চারি দিক আচ্ছন্ন, বরফ পড়ছে। লন্ডন ছাড়িয়ে স্টেশনগুলি বাম দিকে আসতে লাগল। যখন গাড়ি থামে আমি জানলা খুলে বাম দিকে মুখ বাড়িয়ে সেই কুয়াশালিপ্ত অস্পষ্টতার মধ্যে কোনো এক ব্যক্তিকে ডেকে স্টেশনের নাম জেনে নিতে লাগলুম । আমার গম্য স্টেশনটি শেষ স্টেশন। সেখানে যখন গাড়ি থামল আমি বাম দিকেই তাকালুম— সে দিকে আলো নেই প্লাটফর্ম নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রইলুম। ক্ষণকাল পরেই গাড়ি আবার লন্ডনের অভিমুখে পিছোতে আরম্ভ করল । আমি বলি, এ কী হল ! পরের স্টেশনে যখন থামল, জিজ্ঞাসা করলুম অমুক স্টেশন কোথায় ? উত্তর শুনলুম, “সেখান থেকে তুমি যে এইমাত্র আসছ ।” তাড়াতাড়ি নেবে পড়ে জিজ্ঞাসা করলুম। এর পরের গাড়ি কখন পাওয়া যাবে ? উত্তর পেলুম- অর্ধরাত্রে । গম্য স্টেশনটি ডান দিকে ছিল । আমার জীবনযাত্রায় কেবল বঁা দিকের স্টেশনগুলিরই খোজ নিয়ে চলেছি। ডান দিকে কিছুই নেই বলে একেবারে নিশ্চিন্ত । একটার পর একটা পার হয়েই গেলুম ! যে-স্থানে নামবার ছিল সেখানেও সংসারের দিকেই— ঐ বাম দিকেই।- চেয়ে দেখলুম। দেখলুম সমস্ত অন্ধকার, সমস্ত কুয়াশায় অস্পষ্ট। যে সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল সে সুযোগ কেটে গেল— গাড়ি ফিরে চলেছে। যেখানে নিমন্ত্রণ ছিল সেখানে আমোদ আহলাদ অতীত হতে চলল। আবার গাড়ি কখন পাওয়া যাবে ? এই যে সুযোগ পেয়েছিলুম ঠিক এমন সুযোগ কখন পাব- কোন অর্ধরাত্ৰে ! মানবজীবনের ভিতর দিয়েই যে চরম স্থানে যাওয়া যেতে পারে, এমন একটা স্টেশন আছে । সেখানে যদি না নামি— সেখানকার প্ল্যাটফর্ম যে দিকে সে দিকে যদি না তাকাই তবে সমস্ত যাত্ৰাই যে আমার কাছে একটা নিতান্ত কুহেলিকাবৃত নিরর্থক ব্যাপার বলে ঠেকবে তাতে সন্দেহ কী আছে। কেন যে টিকিটের দাম দিলুম, কেন যে গাড়িতে উঠলুম, অন্ধকার রাত্রির ভিতর দিয়ে কেন যে চললুম, কী যে হল কিছুই বোঝা গেল না। নিমন্ত্রণ আমার কোথায় ছিল, ভোজের আয়োজনটা কোথায় হয়েছে,