পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՀՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী এই কথা বলতে পেরেছেন যে, ছোটো হােক বড়ো হােক, উচ্চ হােক নীচ হােক, শত্ৰু হােক মিত্ৰ হােক, সকলেই আমার আপনি । মানুষের মধ্যে যারা শ্ৰেষ্ঠ তীরা এমন জায়গায় সকলের সঙ্গে সমান হয়ে দাঁড়ান যেখানে সর্বব্যাপীর | সঙ্গে তাদের আত্মার যোগস্থাপন হয়। যেখানে মানুষ সকলকে ঠেলেঠলে নিজে বড়ো হয়ে উঠতে চায় সেখানেই তীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে । সেইজন্যেই র্যারা মানবজন্মের সফলতা লাভ করেছেন উপনিষৎ র্তাদের ধীর বলেছেন, যুক্তাত্মা বলেছেন। অর্থাৎ তারা সকলের সঙ্গে মিলে আছেন বলেই শান্ত, তারা সকলের সঙ্গে মিলে আছেন বলেই সেই পরম একের সঙ্গে তাদের বিচ্ছেদ নেই, তারা যুক্তাত্মা | খ্ৰীস্টের উপদেশ-বাণীর মধ্যেও এই কথাটির আভাস আছে। তিনি বলেছেন সূচির ছিদ্রের ভিতর দিয়ে যেমন উট প্রবেশ করতে পারে না, ধনীর পক্ষে মুক্তিলাভও তেমনি দুঃসাধ্য। তার মানে হচ্ছে এই যে, ধন বলো, মান বলো, যা-কিছু আমরা জমিয়ে তুলি তার দ্বারা আমরা স্বতন্ত্র হয়ে উঠি ; তার দ্বারা সকলের সঙ্গে আমাদের যোগ নষ্ট হয়। তাকেই বিশেষভাবে আগলাতে সামলাতে গিয়ে সকলকে দূরে ঠেকিয়ে রাখি। সঞ্চয় যতই বাড়তে থাকে ততই সকলের চেয়ে নিজেকে স্বতন্ত্র বলে গর্ব হয়। সেই গর্বের টানে এই স্বাতন্ত্র্যকে কেবলই বাড়িয়ে নিয়ে চলতে চেষ্টা হয় । এর আর সীমা নেই- আরো বড়ো, আরো বড়ো- আরো বেশি, আরো বেশি । এমনি করে মানুষ সকলের সঙ্গে যোগ হারাবার দিকেই চলতে থাকে, তার সর্বত্র প্রবেশের অধিকার কেবল নষ্ট হয়। উট যেমন সূচির ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে গলতে পারে না সেও তেমনি কেবলই স্কুল হয়ে উঠে নিখিলের কোনো পথ দিয়েই গলতে পারে না, সে আপনার বড়োত্ত্বের মধ্যেই বন্দী। সে ব্যক্তি মুক্তস্বরূপকে কেমন করে পাবে যিনি এমন প্রশস্ততম জায়গায় থাকেন যেখানে জগতের ছোটােবড়ো সকলেরই সমান স্থান । সেইজন্যে আমাদের দেশে এই একটি অত্যন্ত বড়ো কথা বলা হয়েছে যে, তাকে পেতে হলে সকলকেই পেতে হবে । সমস্তকে ত্যাগ করাই তাকে পাওয়ার পন্থা নয় । য়ুরোপের কোনো কোনাে আধুনিক তত্ত্বজ্ঞানী, যারা পরোক্ষে বা প্রত্যক্ষে উপনিষদের কাছেই বিশেষভাবে ঋণী, তারা সেই ঋণকে অস্বীকার করেই বলে থাকেন- ভারতবর্ষের ব্ৰহ্ম একটি অবচ্ছিন্ন (Abstract) পদার্থ। অর্থাৎ জগতে যেখানে যা-কিছু আছে সমস্তকে ত্যাগ করে, বাদ দিয়েই, সেই অনন্তস্বরূপ- অর্থাৎ এক কথায় তিনি কোনোখানেই নেই, আছেন কেবল তত্ত্বজ্ঞানে । এরকম কোনো দার্শনিক মতবাদ ভারতবর্ষে আছে কি না সে কথা আলোচনা করতে চাই নে, কিন্তু এটি ভারতবর্ষের আসল কথা নয় । বিশ্বজগতের সমস্ত পদার্থের মধ্যেই অনন্তস্বরূপকে উপলব্ধি করার সাধনা ভারতবর্ষে এতদূরে গেছে যে অন্য দেশের তত্ত্বজ্ঞানীরা সাহস করে ততদূরে যেতে পারেন না। ঈশাবাস্যমিদং সৰ্বং যৎকিিঞ্চ জগত্যাং জগৎ— জগতে যেখানে যা-কিছু আছে সমস্তকেই ঈশ্বরকে দিয়ে আচ্ছন্ন করে দেখবে, এই তো আমাদের প্রতি উপদেশ । যো দেবোঁহয়ীে যোহপসু যো বিশ্বং ভূবনমাবিবেশ য ওষধিযু যে বনস্পতিযু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ | একেই কি বলে বিশ্ব থেকে বাদ দিয়ে তঁাকে দেখা ? তিনি যেমন অগ্নিতেও আছেন তেমনি জলেও আছেন, অগ্নি ও জলের কোনো বিরোধ তীর মধ্যে নেই। ধান, গম, যব প্রভৃতি যে-সমস্ত ওষধি কেবল কয়েক মাসের মতো পৃথিবীর উপর এসে আবার স্বপ্নের মতো মিলিয়ে যায় তার মধ্যেও সেই নিত্য সত্য যেমন আছেন, আবার যে বনস্পতি অমরতার প্রতিমাস্বরূপ সহস্ৰ বৎসর ধরে পৃথিবীকে ফল ও ছায়া দান করছে তার মধ্যেও তিনি তেমনিই আছেন। শুধু আছেন এইটুকুকে জানা নয়- নমোনমঃ | তাকে নমস্কার, তাকে নমস্কার, সর্বত্রই তাকে নমস্কার ।