পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/৪৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রমেশ রচনাৰলী করিও,—রমাপ্রসাদ সরস্বতীই সে বিবাহে ব্যবস্থা দান করিয়াছিল! আমি কাশীধাম হইতে মধ্যে মধ্যে বঙ্গদেশে আসিতাম—তোমাদের ইতিহাস কিছু কিছু অবগত আছি। শরৎ বিস্মিত হইয়া রহিলেন;–এ রমাপ্রসাদ সরস্বতী কে ? সরস্বতী পুনরায় আপনার ইতিহাস বলিতে লাগিলেন। “কৃপাল সিংহের বিধবা আমাকে ধৰ্ম্মপরায়ণ ও শাস্ত্রজ্ঞ বলিয়া মনে করিতেন, আমি যখন এ বিবাহ ধৰ্ম্মসঙ্গত বলিয়া তাঁহার নিকট বার বার উপরোধ করিলাম, তখন তিনি অবশেষে সম্মত হইলেন। তাঁহার জ্ঞাতিকুটুম্ব কাশীতে এরপে কেহ ছিল না যে এ কায্যে আপত্তি করে। আমার বন্ধবোন্ধব আমাকে অনেক ভৎসনা করিলেন, আমার মঠ ভাঙ্গিয়া গেল, শেষে আমি নববধ ও তাহার মাতাকে লইয়া কাশী হইতে পলায়ন করিতে বাধ্য হইলাম; কিন্তু কাৰ্য্য অন্যায় বা শাস্ত্রবহিগত বলিয়া আমার বোধ হয় না, হেমবাবরে এ বিষয়ে কি মত, তাহা জানিতে আমি বাসনা করি।” হেমচন্দ্র। আপনি নিরাশ্রয় ক্ষত্রিয় বালিকাকে বিবাহ করিয়া আপনার দয়া, আপনার সাহস, আপনার ধৰ্ম্মমপ্রিয়তা দেখাইয়াছেন। সরস্বতী। হেমবাব, তোমার ন্যায় আদশ চরিত্র লোকের এইরুপ মত হওয়াই সম্ভব। ভগিনী বিন্দবাসিনী যখন অনাথা দরিদ্রা বালিকা ছিলেন, তুমি তাঁহাকে বিবাহ করিয়া নিজের দয়া, সাহস ও ধৰ্ম্মপ্রিয়তা প্রদর্শন করিয়াছিলে! ভগিনী বিন্দবাসিনীকে জিজ্ঞাসা করিও,— তাঁহার বাল্যাবস্থায় রমাপ্রসাদ সরস্বতী তাঁহার হাত দেখিয়া ভবিষ্যৎ বলিয়াছিল। হেমচন্দ্র বিস্মিত হইয়া রহিলেন । রমাপ্রসাদ সরস্বতী কে ? ক্ষণেক পর সরস্বতী আবার বলিলেন,—হেমচন্দ্র! তুমিও অনাথা বালিকা বিবাহ করিয়াছিলে, কিন্তু তিনি সবজাতীয়া। আমার ন্যায় অন্যজাতীয়া বালিকা বিবাহ করিলে কিছুমাত্র আত্মগ্রানি বোধ করিতে না ? হেম। কিছুমাত্র না। সরস্বতী। আত্মীয় কি পরিবারের মধ্যে যদি কেহ ভিন্ন জাতির সহিত বিবাহ-সম্মবন্ধ স্থাপন করে, তাহাকে কিছুমাত্র নিন্দা করিবে না ? হেম । কিছুমাত্র না। সরস্বতী। তোমার নিজের এরপে অবস্থা হইলে এরপে কাৰ্য্য করিতে সম্মত হইবে ? লক্ষীসমা শান্তহৃদয়া তোমার দ্বাদশবষণীয়া সশীলা নানী যে কন্যা আছে, তাহার সহিত অন্য জাতীয় উপযুক্ত পাত্রের সহিত শুভবিবাহে তোমার কোনরাপ আপত্তি হইবে না ? হেমচন্দ্র এ প্রশেন বিস্মিত হইলেন! উত্তর করিলেন,—গরদেব ! পাত্র যদি উপযুক্ত হয়েন, এ কায্যে আমি কিছুমাত্র আপত্তি করিব না। সরস্বতী তখন হাসিয়া বলিল্লেন, “নিশ্চিন্ত হও । আমি আপাততঃ সশীলা মাতার সহিত আমার পত্রের বিবাহ প্রস্তাব করিতেছি না, তোমার মনটী জানিবার জন্য একথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম।” সকলে ক্ষণেক নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। পরে হেমচন্দ্র বলিলেন,—গরদেব, আপনার ইতিহাসের শেষাংশ জানিতে বড় ঔৎসুক্য হইতেছে, আপনার বধ ও বধমাতা এক্ষণে কোথায ? সরস্বতী একটী দীঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “আমার ইতিহাস সাঙ্গ প্রায়, আমার জীবনের আশা-ভরসাও সাঙ্গ হইয়াছে। বিবাহের দুই বৎসর পরই দৌহিত্র মুখ দেখিয়া আমার শাশড়ী ঠাকুরাণী মানবলীলা সম্বরণ করেন। তাহার পর আমি পত্র-কলয় লইয়া মথুরায় ১৫ বৎসর যাবৎ আবাস করিতেছিলাম। সেখানে প্রত্যহ প্রাতে যমুনাতীরে অনন্ত মহিমাপণ গায়ত্রী উচ্চারণ করিয়া পরমাত্মার বিকাশাংশ সৰ্য্যেদেবকে আরাধনা করিতাম, সায়ংকালে ষমনাঘাটে বসিয়া শিষ্যদিগকে উপনিষদগুলির অচিন্তনীয় অর্থ শিখাইতাম। প্রিয় পত্রকে নিজেই সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাদান করিতাম এবং তথাকার বিদ্যালয়ে ইংরাজী শিখাইতাম, এবং স্নেহময়ী ভাৰ্য্যার যত্নে আমার এই ক্ষুদ্র কুটীরে সবগাসখ ভোগ করিতাম। সে স্নেহময়ী অস্তহিতা হইলেন, আমার মন বিচলিত হইল, পত্রকে সঙ্গে লইয়া দেশে দেশে পয্যটন করিতেছি।” সরস্বতী নিস্তন্ধে চক্ষ হইতে দুই একটা অশ্রুবিন্দ ত্যাগ করিলেন। হেম ও শরৎ অচিরে বিদায় গ্রহণ করিয়া তালপুকুরে প্রত্যাবৰ্ত্তন করিলেন। 8& O