পর্য্যন্ত এই অরণ্য বিস্তৃত। এমন কোনও একটি স্থান যদি আবিষ্কার করা সম্ভব হইত, যেখান হইতে লতাগুল্মাচ্ছাদিত সুদূরপ্রসারী এই বনভূমিকে একটি সম্পূর্ণ পরিদৃশ্যমান আলেখ্যের মত দেখিবার পথে কোনও অন্তরায় উপস্থিত না হইত তাহা হইলে দেখা যাইত যে, ঘনসন্নিবিষ্ট এই বনভূমির কোথাও একটু ফাঁক নাই। বিষধর সর্পের এই অন্ধকার আবাসভূমিও যে মনুষ্যপদশব্দে চকিত হইয়া উঠে, তাহার প্রমাণস্বরূপ এক অতি সঙ্কীর্ণ পায়ে-চলার পথ আছে; কিন্তু এই পায়ে-চলার-পথ খুঁজিয়া বাহির করিতে হইলে গভীর পর্য্যবেক্ষণ-শক্তির প্রয়োজন। এই পদচিহ্ন ধরিয়া সামান্য অগ্রসর হইতে না হইতেই পথ হারাইয়া যায়; অরণ্যের তৃণ ও অন্ধকার নিঃশেষে পথের সকল চিহ্ন গ্রাস করে। এই পথে চলিতে অভ্যস্ত যাহারা, তাহদের কথা স্বতন্ত্র; এই চিহ্নহীন আঁকাবাঁকা পথেই তাহাদের অভ্যস্ত চক্ষু তাহাদিগকে অভ্যন্তরে লইয়া যায়, বনের ঠিক কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত তৃণ-কুটীরটি পর্য্যন্ত। কুটীরের চালটি আশপাশের ঝোপগুলি হইতে একটু উচ্চ হইলেও সন্নিহিত বৃক্ষের শাখাপত্র কৌশলে টানিয়া ও সাজাইয়া এমনভাবে চালটিকে গোপন করা হইয়াছে যে কাহারও কৌতুহলী দৃষ্টি সেদিকে পড়িবার সম্ভাবনা ছিল না; সমস্তটা মিলিয়া কুটীরটিকে অপেক্ষাকৃত উচ্চ একটা ঝোপ বলিয়াই মনে হইত। এই ক্ষুদ্র দুর্দ্দশাগ্রস্ত কুটীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেই মনে কেমন একটা অস্বস্তিকর ভাব জাগে, নিরানন্দে মন ভরিয়া উঠে। কুটীরের মেঝে অত্যন্ত স্যাঁতসেঁতে। বাঁশ এবং দরমা নির্ম্মিত দেওয়াল, ভিজা মেঝেতেও দুই-তিন পুরু দরমা বিস্তৃত; এক কোণে মৃত্তিকানির্ম্মিত ধূম্রকৃষ্ণ রন্ধনের কয়েকটি পাত্র জড়ো করা ছিল; দেখিলেই মনে হয় যে, এগুলি ক্কচিৎ ব্যবহৃত হয়।
প্রত্যুষ তখনও অতিক্রান্ত হয় নাই; ঘনসন্নিবিষ্ট বৃক্ষপত্রের অন্তরালপথে প্রাতঃসূর্য্যের সুদীর্ঘ রশ্মি তখনও বনভূমিতে দৃষ্টিগোচর হইতেছিল।