পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যজ্ঞ-কথা : সোমযাগ 8vo, সাহিত্যের অতি প্রাচীন স্তরে সোমের সহিত চন্দ্রের কোন সম্পর্কই ছিল না ; বেদের সোম গোড়ায় সোমলতা মাত্র ; উদ্ভিদ মাত্র। সোম পান করিলে মত্তত জন্মিত এবং লোকে ফুৰ্ত্তি ও বল পাইত ; এই জন্য সোমকে দেবতা করিয়া লইয়াছিল । ইরাণীরা সোমকে হেীমা বলিত। আমাদের দেশে সোমযাগ একেবারে উঠিয়া গিয়াছে ; কিন্তু বোম্বাইয়ের পাসীরা এখনও সোমযাগ করিয়া থাকেন। এখন যে উদ্ভিদের রস র্তাহারা এজন্য ব্যবহার করেন, তাহাকে হুম বলে । মার্টিন হৌগ নামক পণ্ডিত মূল ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং তাহার ইংরেজী অনুবাদ প্রচার করিয়াছিলেন, এবং বোম্বাইয়ে থাকিয়া পাসাঁদের প্রাচীন এবং আধুনিক ধৰ্ম্মকৰ্ম্ম সম্বন্ধে অনেক অমুসন্ধান করিয়াছিলেন। তিনি এই হুম রস পান করিয়া দেখিয়াছিলেন যে, উহা অত্যন্ত বিস্বাদ । উহাতে কোন দেবতার বা কোন মানুষের তৃপ্তির কোন সম্ভাবনা নাই। ফলকথা, পুরাকালে যে সোম যজ্ঞার্থ ব্যবহৃত হইত, সে সোম কোন উদ্ভিদ, তাহ কেহ এখন জানে না। বেদপন্থী সমাজে যখন সোমযাগের বহুল প্রচার ছিল, তখনও ইহা দুষ্প্রাপ্য হইয়া আসিতেছিল। পৰ্ব্বত হইতে সোম আনিয়া যজ্ঞের জন্য সংগ্ৰহ করিয়া রাখা এক দল লোকের ব্যবসায় দাড়াইয়াছিল। যজ্ঞের সময় সোমবিক্রেতা যজ্ঞশালার বাহিরে আসিয়া বসিত । যজমান মূল্য দিয়া তাহা খরিদ করিয়া লইতেন। সোম ক্রমশঃ দুলভ হওয়াই সোমযজ্ঞ অপ্রচলিত হওয়ার একটা মুখ্য কারণ মনে করা যাইতে পারে। কিন্তু যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখনও বেদপন্থী দ্বিজাতি-সমাজে সোমযজ্ঞের বহুল প্রচার ছিল । নানাবিধ সোমযাগ তখন প্রচলিত ছিল। ক্ষত্রিয় রাজারা যে অশ্বমেধ, রাজস্থয় প্রভৃতি মহা আড়ম্বরের যজ্ঞ করিতেন, তাহাও সোমবাগ। ক্ষত্রিয় এবং বৈশু্যরা কালক্রমে সোমপানের অধিকারে বঞ্চিত হইয়াছিলেন । সোমপানে অধিকার ব্রাহ্মণের নিজস্ব করিয়া লইয়াছিলেন। ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্ব যজমানেরা সোমযজ্ঞ করিতে পারিতেন, কিন্তু তাহাদিগকে সোমরসের পরিবৰ্ত্তে অন্য দ্রব্য পান করিতে হইত। ক্ষত্রিয়ের বট, অশ্বথ, প্লক্ষ বা যজ্ঞডুমুরের রস পান করিতেন ; বৈশ্বের পক্ষে দধির ব্যবস্থা ছিল ; ইহাতেই তাহাদের সোমপানের ফল হইত। ক্ষত্রিয়েরা সোমপান করিতে পাইবেন কি না, তাহ লইয়া কিছু দিন ধরিয়া তর্ক-বিতর্ক, গণ্ডগোল চলিয়াছিল । ক্ষত্রিয়েরা সহজে অধিকার ছাড়িতে চাহেন নাই। ইহা লইয়া যজ্ঞের সময় হাতাহাতি মারামারি পর্য্যস্ত হইত। যাহারা এ বিষয়ে কুতুহলী, তাহারা আমার ঐতরেয় ব্রাহ্মণের বাঙ্গালা অনুবাদের পয়ত্ৰিশ অধ্যায় পড়িয়া দেখিবেন । র্যাহারা ক্ষত্রিয়ের সোমপানের বিরোধী ছিলেন, তাহারা একটা খুব বড় নজির দেখাইতেন । দেবতাদের রাজা ইন্দ্র ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপকে বধ করিয়াছিলেন ; বৃত্রকে বধ করিয়াছিলেন ; আরও অনেক অকুচিত কাজ করিয়াছিলেন। বিশ্বরূপ এবং বৃত্র, উভয়েই দেবতাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ ছিলেন। ইন্দ্র ক্ষত্রিয় ছিলেন। ইন্দ্র এইরূপে ব্ৰহ্মহত্যায় লিপ্ত হইলে দেবতারা বিদ্রোহী হইয়া ইন্দ্রের সোমপান বন্ধ করিরা দেন। দেখাদেখি ক্ষত্রিয়দেরওসোমপান নিষিদ্ধ হইয়াছে। বেদপন্থী সমাজে নানাবিধ সোমযাগের অনুষ্ঠান ক্রমশঃ পল্পবিত হইয়া উঠিয়াছিল ।