পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/১২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর: দ্বিতীয় খণ্ড ১০৩

 পথিকা স্ত্রীলোকেরা আমার দিকে চাহিয়া হাস্য পরিহাস করিতেছিল। তাহাদের ভাষা না বুঝিলেও ইহা স্পষ্ট বুঝিলাম যে, তাহাদের উপহাসের লক্ষ্য আমিই। সঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম—

 ‘উহারা কি বলিতেছে?’

 উত্তর পাইলাম,—‘উহারা বলে যে, আপনি অনেকটা পুরুষভাবাপন্ন।’

 ‘পুরুষভাবাপন্ন। ইহার মানে কী?’

 ‘ইহার অর্থ এই যে, আপনাকে পুরুষের মত ভীরু ও লজ্জানম্র দেখায়!’

 ‘পুরুষের মত লজ্জানম্র!’ এমন ঠাট্টা! এরূপ উপহাস তো কখন শুনি নাই। ক্রমে বুঝিতে পারিলাম, আমার সঙ্গিনী সে দার্জিলিংবাসিনী ভগিনী সারা নহেন—ইঁহাকে কখনও দেখি নাই! ওহো! আমি কেমন বোকা—একজন অপরিচিতার সহিত হঠাৎ চলিয়া আসিলাম! কেমন একটু বিস্ময়ে ও ভয়ে অভিভূত হইলাম। আমার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত ও ঈষৎ কম্পিত হইল। তাঁহার হাত ধরিয়া চলিতেছিলাম কিনা, তিনি আমার হস্তকম্পন অনুভব করিয়া সস্নেহে বলিলেন—

 ‘আপনার কী হইয়াছে? আপনি কাঁপিতেছেন যে!’

 এরূপে ধরা পড়ায় আমি লজ্জিত হইলাম। ইতস্তত করিয়া বলিলাম, ‘আমার কেমন একটু সঙ্কোচ বোধ হইতেছে; আমরা পর্দানশীন স্ত্রীলোক, আমাদের বিনা অবগুণ্ঠনে বাহির হইবার অভ্যাস নাই।’

 ‘আপনার ভয় নাই—এখানে আপনি কোন পুরুষের সম্মুখে পড়িবেন না। এ দেশের নাম ‘নারীস্থান’[১] এখানে স্বয়ং পুণ্য নারীবেশে রাজত্ব করেন।’

 ক্রমে নগরের দৃশ্যাবলি দেখিয়া আমি অন্যমনস্ক হইলাম। বাস্তবিক পথের উভয় পার্শ্বস্থিত দৃশ্য অতিশয় রমনীয় ছিল। সুনীল অম্বর দর্শনে মনে হইল যেন ইতিপূর্বে আর কখনো এত পরিষ্কার আকাশ দেখি নাই! একটি তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তর দেখিয়া ভ্রম হইল, যেন হরিৎ মখমলের গালিচা পাতা রহিয়াছে। ভ্রমণকালে আমার বোধ হইতেছিল, যেন কোমল মসনদের উপর বেড়াইতেছি—ভূমির দিকে দৃকপাত করিয়া দেখি, পথটি শৈবাল ও বিবিধ পুষ্পে আবৃত! আমি তখন সানন্দে বলিয়া উঠিলাম, ‘আহা! কি সুন্দর!’

 ভগিনী সারা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি এসব পছন্দ করেন কি?’ (আমি তাঁহাকে ‘ভগিনী সারা’ই বলিতে থাকিলাম এবং তিনিও আমার নাম ধরিয়া সম্বোধন করিতেছিলেন।)

 ‘হ্যাঁ এসব দেখিতে বড়ই চমৎকার। কিন্তু আমি এ সুকুমার কুসুমস্তবক পদদলিত করিতে চাই না।’

 ‘সেজন্য ভাবিবেন না, প্রিয় সুলতানা! আপনার পদস্পর্শে এ-ফুলের কোন ক্ষতি হইবে না। এগুলি বিশেষ এক জাতীয় ফুল, ইহা রাজপথেই রোপণ করা হয়।’

 দুইধারে পুষ্পচূড়াধারী পাদপশ্রেণী সহাস্যে শাখা দোলাইয়া দোলইয়া যেন আমার অভ্যর্থনা করিতেছিল। দূরাগত কেতকী-সৌরভে দিক-পরিপূরিত ছিল। সে সৌন্দর্য ভাষায়


  1. “পরিস্থান” শব্দের অনুকরণে “নারীস্থান” বলা হইল। ইংরাজিতে “লেডী ল্যাণ্ড” বলা গিয়াছে।