পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/১৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১০ রোকেয়া রচনাবলী

ছিলেন। তিনি আমাদের সহৃদয়া মহারানিকে ঐ আসামি ধরিয়া দিতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু মহারানি তো দয়াপ্রতিমা জননীর জাতি—সুতরাং তাঁহার আশ্রিত হতভাগ্যদিগকে ক্রুদ্ধ রাজার শোণিত-পিপাসা নিবৃত্তির জন্য ধরিয়া দিলেন না। প্রবল ক্ষমতাশালী রাজা ইহাতে ক্রোধান্ধ হইয়া আমাদের সহিত যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত হইলেন।

 ‘আমাদের রণসজ্জাও প্রস্তুত ছিল, সৈন্য সেনানীগণও নিশ্চিন্ত ছিলেন না। তাঁহারা বিরোচিত উৎসাহে শত্রুর সম্মুখীন হইলেন। তুমুল সংগ্রাম বাঁধিল, রক্তগঙ্গায় দেশ ডুবিয়া গেল! প্রতিদিন যোদ্ধাগণ অম্লানবদনে পতঙ্গপ্রায় সমরানলে প্রাণ বিসর্জন দিতে লাগিল।

 ‘কিন্তু শত্রুপক্ষ অত্যন্ত প্রবল ছিল, তাহাদের গতিরোধ করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। আমাদের সেনাদল প্রাণপণে কেশরীবিক্রমে যুদ্ধ করিয়াও শনৈ শনৈ পশ্চাদবর্তী হইতে লাগিল, এবং শত্রুগণ ক্রমশ অগ্রসর হইল।

 ‘কেবল বেতনভোগী সেনা কেন, দেশের ইতর-ভদ্র—সকল লোকই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইল। এমনকি ৬০ বৎসরের বৃদ্ধ হইতে ষোড়শবর্ষীয় বালক পর্যন্ত সমরশহিদ হইতে চলিল। কতিপয় প্রধান সেনাপতি নিহত হইলেন; অসংখ্য সেনা প্রাণ হারাইল। অবশিষ্ট যোদ্ধাগণ বিতাড়িত হইয়া পৃষ্ঠপ্রদর্শনে বাধ্য হইল। শত্রু এখন রাজধানী হইতে মাত্র ১২/১৩ ক্রোশ দূরে অবস্থিত। আর দুই-চারি দিবসের যুদ্ধের পরেই তাহারা রাজধানী আক্রমণ করিবেন।

 ‘এই সঙ্কট সময়ে সম্রাজ্ঞী জন-কতক বুদ্ধিমতী মহিলাকে লইয়া সভা আহ্বান করিলেন। এখন কী করা কর্তব্য ইহাই সভার আলোচ্য বিষয় ছিল।

 ‘কেহ প্রস্তাব করিলেন যে, রীতিমতো যুদ্ধ করিতে করিতে যাইবেন, অন্যদল বলিলেন যে, ইহা অসম্ভব—কারণ একে তো অবলারা সমরনৈপুণ্যে অনভিজ্ঞ তাহাতে আবার কৃপাণ, তোষাদান, বন্দুক ধারণেও অক্ষমা; তৃতীয়া দল বলিলেন যে, যুদ্ধনৈপুণ্য দূরে থাকুক—রমণীর শারীরিক দুর্বলতাই প্রধান অন্তরায়।’

 মহারানি বলিলেন, ‘যদি আপনারা বাহুবলে দেশরক্ষা করিতে না পারেন, তবে মস্তিষ্কবলে দেশরক্ষার চেষ্টা করুন।’

 সকলে নিরুত্তর, সভাস্থল নীরব। মহারানি মৌনভঙ্গ করিয়া পুনরায় বলিলেন, ‘যদি দেশ ও সম্ভ্রম রক্ষা করিতে না পারি, তবে আমি নিশ্চয় আত্মহত্যা করিব।’

 ‘এইবার দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডি প্রিন্সিপ্যাল (যিনি সৌরকর করায়ত্ত করিয়াছেন) উত্তর দিলেন। তিনি এতক্ষণে নীরবে চিন্তা করিতেছিলেন—এখন অতি ধীরে গম্ভীরভাবে বলিলেন যে, বিজয় লাভের আশাভরসা তো নাই—শত্রু প্রায় গৃহতোরণে। তবে তিনি একটি সঙ্কল্প স্থির করিয়াছেন—যদি এই উপায় শত্রু পরাজিত হয়, তবে তো সুখের বিষয়। এই উপায় ইতিপূর্বে আর কেহ অবলম্বন করে নাই—তিনিই প্রথমে এই উপায়ে শত্রুজয়ের চেষ্টা করিবেন। এই তাঁহার শেষ চেষ্টা—যদি এই উপায়ে কৃতকার্য হওয়া না যায়, তবে অবশ্য সকলে আত্মহত্যা করিবেন। উপস্থিত মহিলাবৃন্দ দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, তাঁহারা কিছুতেই দাসত্ব-শৃঙ্খল পরিবেন না। সেই গভীর নিস্তব্ধ রজনীতে মহারানির সভাগৃহ অবলাকণ্ঠের প্রতিজ্ঞা ধ্বনিতে পুন পুন প্রতিধ্বনিত হইল। প্রতিধ্বনি ততোধিক উল্লাসের স্বরে বলিল,