পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/১৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১২ রোকেয়া রচনাবলী

 ‘দেখিয়াছি।’

 ‘তবে মনে করুন, আমাদের সঙ্গে অন্যূন দ্বি-সহস্র সার্চলাইট ছিল—অবশ্য সে যন্ত্রগুলি ঠিক সার্চলাইটের মতো নয়, তবে অনেকটা সাদৃশ্য আছে, কেবল আপনাকে বুঝাইবার জন্য তাহাকে ‘সার্চলাইট’ বলিতেছি। স্টিমারের সার্চলাইটে উত্তাপের প্রখরতা থাকে না, কিন্তু আমাদের সার্চলাইটে ভয়ানক উত্তাপ ছিল; ছাত্রীগণ যখন সেই সার্চলাইটের কেন্দ্রীভূত উত্তাপরশ্মি শত্রুর দিকে পরিচালিত করিলেন—তখন তাহারা হয়তো ভাবিয়াছিল, একি ব্যাপার! শত-সহস্র সূর্য মর্ত্যে অবতীর্ণ। সে উগ্র উত্তাপ ও আলোক সহ্য করিতে না পারিয়া শত্রুগণ দিগ্‌বিদিগ্‌ জ্ঞানশূন্য হইয়া পলায়ন করিল। নারীর হস্তে একটি লোকেরও মৃত্যু হয় নাই—একবিন্দু নরশোণিতেও বসুন্ধরা কলঙ্কিত হয় নাই—অথচ শত্রু পরাজিত হইল। তাহারা প্রস্থান করিলে পর তাহাদের সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র সূর্যকিরণে দগ্ধ করা গেল।’

 আমি বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া বলিলাম, ‘যদি বারুদ দগ্ধকালে ভয়ানক দুর্ঘটনা হইয়া আপনাদের কোনো অনিষ্ট হইত!’

 ‘আমাদের অনিষ্টের সম্ভাবনা ছিল না, কারণ বারুদ ছিল বহুদূরে। আমরা রাজধানীতে থাকিয়াই সার্চলাইটের তীব্র উত্তাপ প্রেরণ করিয়াছিলাম। তবু অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য জলধর বেলুন সঙ্গে রাখা হইয়াছিল। তদবধি আর কোন প্রতিবেশী রাজা-মহারাজা আমাদের দেশ আক্রমণ করিতে আইসেন নাই।’

 ‘তারপর পুরুষ-প্রবরেরা অন্তঃপুরের বাহিরে আসিতে চেষ্টা করেন নাই কি?’

 ‘হাঁ, তাঁহারা মুক্তি পাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কতিপয় পুলিশ কমিশনার ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এই মর্মে মহারানি সমীপে আবেদন করিয়াছিলেন যে, যুদ্ধে অকৃতকার্য হওয়ার দোষে সমর বিভাগের রাজকর্মচারীগণই দোষী, সেজন্য তাঁহাদিগকে বন্দি করা ন্যায়সঙ্গত হইয়াছে, কিন্তু অপর রাজপুরুষেরা তো কদাচ কর্তব্যে অবহেলা করেন নাই, তবে তাঁহারা অন্তঃপুর কারাগারে বন্দি থাকিবেন কেন? তাঁহাদের পুনরায় স্ব-স্বকার্যে নিযুক্ত করিতে আজ্ঞা হউক।’

 ‘মহারানি তাঁহাদিগকে জানাইলেন যে, যদি আবার কখনো রাজকার্যে তাঁহাদের সহায়তার আবশ্যক হয়, তবে তাঁহাদিগকে যথাবিধি কার্যে নিযুক্ত করা হইবে। রাজ্যশাসন ব্যাপারে তাঁহাদের সাহায্যের প্রয়োজন না হওয়া পর্যন্ত তাঁহারা যেখানে আছেন, সেইখানে থাকুন।

 ‘আমরা এই প্রথাকে ‘জেনানা’ না বলিয়া ‘মর্দানা’ বলি।’

 আমি বলিলাম, ‘বেশ তো। কিন্তু এক-কথা—পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট ইত্যাদি তো ‘মর্দানায়’ আছেন, আর চুরি ডাকাতির তদন্ত এবং হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি অত্যাচার অনাচারের বিচার করে কে?’

 ‘যদবধি ‘মর্দানা’ প্রথা প্রচলিত হইয়াছে, তদবধি এদেশে কোনোপ্রকার পাপ কিংবা অপরাধ হয় নাই, সেইজন্য আসামি গ্রেফতারের নিমিত্ত আর পুলিশের প্রয়োজন হয় না—ফৌজদারি মোকদ্দমার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটেরও আবশ্যক নাই।’