পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/১৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর: দ্বিতীয় খণ্ড ১১৫

ফেলিবার জন্য ভাঙাকুলা’ মাত্র। আপনাকে আর-একটি কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া থাকতে পারিতেছি না, আপনারা গ্রীষ্মকালে বাড়িঘর ঠাণ্ডা রাখেন কিরূপে? আমরা তো বৃষ্টিধারাকে স্বর্গের অমিয় ধারা মনে করি।’

 ‘আমাদেরও সুস্নিগ্ধ বৃষ্টিধারার অভাব হয় না। তবে আমরা পিপাসী চাতকের ন্যায় জলধরের কৃপা প্রার্থনা করি না, এখানে কাদম্বিনী আমাদের সেবিকা—সে আমাদের ইচ্ছানুসারে শীতল ফোয়ারায় ধরণী সিক্ত করিয়া দেয়। আবার শীতকালে সূর্যোত্তাপে গৃহগুলি ঈষৎ উত্তপ্ত রাখা হয়।’

 অতঃপর তিনি আমাকে তাঁহার স্নানাগার দেখাইলেন। এ-কক্ষের ছাদটা বাক্সের ডালার মতো। ছাদ তুলিয়া ফেলিয়া ইচ্ছামতো বৃষ্টিজলে স্নান করা যায়। প্রত্যেকের গৃহপ্রাঙ্গণে বেলুনের ন্যায় বৃহৎ জলাধার আছে—আদি বেলুনের সহিত ঐ জলাধারগুলির যোগ আছে। আমি মুগ্ধভাবে বলিলাম, ‘আপনারা ধন্য। স্বয়ং প্রকৃতি আপনাদের সেবাদাসী, আর কী চাই! পার্থিব সম্পদে তো আপনারা অতিশয় ধনী, আপনাদের ধর্মবিধান কিরূপ—জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?’

 ‘আমাদের ধর্ম—প্রেম ও সত্য। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসিতে ধর্মত বাধ্য এবং প্রাণান্তেও সত্যত্যাগ করিতে পারি না। যদি কালেভদ্রে কেহ মিথ্যা বলে ....’

 ‘তবে তাহার প্রাণদণ্ড হয়?’

 ‘না, প্রাণদণ্ড হয় না। আমরা ঈশ্বরের সৃষ্টিজগতের জীবহত্যায়, বিশেষত মানবহত্যায় আমোদবোধ করি না। কাহারও প্রাণনাশ করিতে অপর প্রাণীর কী অধিকার? অপরাধীকে নির্বাসিত করা হয়, এবং তাহাকে এদেশে কিছুতেই পুনঃপ্রবেশ করিতে দেওয়া হয় না।’

 ‘কোনো মিথ্যাবাদীকে কখনো ক্ষমা করা হয় না কি?’

 ‘যদি কেহ অকপট হৃদয়ে অনুতপ্ত হয়, তাহাকে ক্ষমা করা যায়।’

 ‘এ-নিয়ম অতি উত্তম। এখানে যে ধর্মই রাজত্ব করিতেছে। ভালো, একবার, মহারানিকে দেখিতে পাইব কি? যিনি করুণাপ্রতিমা, নানা গুণের আধার, তাঁহাকে দেখিলেও পুণ্য হয়।’

 ‘বেশ চলুন।’ এই বলিয়া ভগিনী সারা যাত্রার আয়োজন করিতে লাগিলেন। একখণ্ড তক্তায় দুখানি আসন স্ক্রু দ্বারা আঁটা হইল। পরে তিনি কতিপয় গোলা আনিলেন। গোলা কয়টি দেখিতে বেশ চক্‌চকে ছিল, কোন্‌ ধাতুতে গঠিত তাহা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না, আমার মনে হইল উৎকৃষ্ট রোপ্য-নির্মিত বলিয়া। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার ওজন কত। আমি জীবনে কোনোদিন ওজন হই নাই, কাজেই নিজের গুরুত্ব আমার জানা ছিল না, ভগিনী বলিলেন, ‘আসুন তবে আপনাকে ওজন করি। ওজনটা জানা প্রয়োজন।’

 আমি ভাবিলাম, একি ব্যাপার! যাহা হউক ওজনে আমি একমণ ষোল সের হইলাম। শুনিলাম, তিনি আটত্রিশ সের মাত্র। তবে ভগিনী সারার অপেক্ষা আর কোনো গুণে না হউক আমি গুরুত্বে বেশি তো।

 তারপর দেখিলাম, ঐ চক্‌চকে গোলার ছোটবড় দুইটি গোলা এই তক্তায় সংযোগ করা হইল। আমি প্রশ্ন করিয়া জানিলাম, সে-গোলা হাইড্রোজেন পূর্ণ। তাহারই সাহায্যে আমরা