পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/১৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর: দ্বিতীয় খণ্ড ১১৭

 উপরোক্ত দ্রষ্টব্য স্থানসমূহ পরিদর্শনের পর আমরা পুনরায় সেই বায়ুযানে আরোহণ করিলাম। কিন্তু সেই আমাদের তখ্‌তে রওয়াঁখানি ঈষৎ হেলিয়া ঊর্ধ্বে উঠিতে লাগিল, আমি কী জানি কিরূপে আসনচ্যুত হইলাম—সেই পতনে আমি চমকিয়া উঠিলাম। চক্ষু খুলিয়া দেখি, আমি তখনো সেই আরামকেদারায় উপবিষ্ট।


ডেলিশিয়া-হত্যা[১]

‘হত্যা’ শব্দ শুনিয়া পাঠিকা ভগিনী ভয় পাইবেন না যে ইহা সত্যই ছোরা তরবারি বা বন্দুক পিস্তল দ্বারা রক্তারক্তি বিশিষ্ট হত্যাকাণ্ড! প্রসিদ্ধা গ্রন্থকর্ত্রী মিস মেরি করেলি ‘ডেলিশিয়া হত্যা’ নামক এই উপন্যাসখানি লিখিয়াছেন। ডেলিশিয়া কাহিনীর সহিত আমাদের নারীসমাজের এমন চমৎকার সাদৃশ্য আছে যে, গ্রন্থখানি পাঠকালে অবাক হইয়া বলিতে ইচ্ছা করে—

“এ পোড়া ভারত অন্তঃপুরের কথা
জানিল কী ছলে মেরি করেলি।”

অদ্য আমরা ইংলণ্ডের সামাজিক অবস্থার সহিত আমাদের সমাজের দুরবস্থার তুলনা করিয়া দেখিব, অবলা পীড়নে কোন্ সমাজ কিরূপ সিদ্ধহস্ত।

 ইংরাজ রমণীর জীবন কিরূপ? আমরা মনে করি, তাহারা স্বাধীন, বিদূষী, পুরুষের সমকক্ষা, সমাজে আদৃতা—তাঁহাদের আরও কত কী সুখ-সৌভাগোর চাকচিক্যময় মূর্তি মানস-নয়নে দেখি। কিন্তু একবার তাহাদের গৃহাভ্যন্তরে উঁকি মারিয়া দেখিতে পাইলে বুঝি সব ফাঁকা। দূরের ঢোল শুনিতে শ্রুতিমধুর। সভ্যতা ও স্বাধীনতার লালনভূমি লণ্ডন নগরীতে শত শত ‘ডেলিশিয়া বধকাব্য’ নিত্য অভিনীত হয়। রমণী পৃথিবীর সর্বত্রই অবলা!!

 সংবাদপত্রসমূহে কোনো কোনো বিখ্যাত ইংরাজ-দম্পতির প্রতিকৃতি দেখিলে আমাদের মনে হয়—লর্ড অমুক তো বেশ প্রতিপত্তিশালী, জগতের চক্ষে ধাঁধা লাগান, কিন্তু লেডি অমুকের বুকখানি চিরিয়া দেখিলে জানিতে পারিতাম তাহাতে সুখ কতখানি।

 গ্রন্থকর্ত্রী মেরি করেলি স্বয়ং অবলা, তাই ডেলিশিয়ার মর্মবেদনা অতি নিপুণতার সহিত অঙ্কিত করিতে পারিয়াছেন। এবং অবলা পাঠিকারাই সম্যকরূপে ‘ডেলিশিয়া বধের’ মর্ম গ্রহণ করিতে পারেন। এই চমৎকার উপন্যাসের অবিকল অনুবাদ করা সহজ ব্যাপার নহে, তবু উহার গল্পাংশের অনুবাদ পাঠিকা ভগিনীদিগকে উপহার দিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিতেছি না।

  1. প্রকৃত উচ্চারণ ‘ডিলিশিয়া’, কিন্তু বঙ্গভাষায় ‘ডেলিশিয়া’ শ্রুতিমধুর বোধহয় বলিয়া আমরা ‘ডেলিশিয়া’ লিখিলাম।