পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/১৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪২ রোকেয়া রচনাবলী

মূর্খেরা ললনাদিগকে জ্ঞানফল ভক্ষণ করিতে নিষেধ করে; কালক্রমে ঐ নিষেধ সামাজিক বিধানরূপে পরিগণিত হইল এবং পুরুষেরা এ ফল নিজেদের জন্য একচেটিয়া করিয়া লইল। রমণীবৃন্দ এ ফলের চয়ন ও ভক্ষণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এ গাছের সেবা শুশ্রুষায় বিমুখ হইল। কালে নারীর কোমল হস্তের সেবা-যত্নে বঞ্চিত হওয়ায় জ্ঞানবৃক্ষ মরিয়া গিয়াছে। যাও, তোমরা দেশে ফিরিয়া যাও; এখন সেই পেয়ারার বীজ বপন কর গিয়া। জিনগণ যে গাছ কাটিতে চাহে, কাটুক; তোমরা তাহাদের বাধা না দিয়া গোপনে বীজ সঞ্চয় করিয়া রাখিও। এখন তোমরা নরনারী উভয়ে মিলিয়া নব রোপিত পেয়ারা চারার যত্ন করিও, তাহা হইলে আশানুরূপ ফল প্রাপ্ত হইবে। সাবধান! আর কন্যাজাতিকে পেয়ারায় বঞ্চিত করিও না! নারীর আনীত জ্ঞানফলে নারীর সম্পূর্ণ অধিকার আছে, একথা অবশ্য স্মরণ রাখিবে!” নিদ্রাভঙ্গে তিনি এই স্বপ্নবৃত্তান্ত সঙ্গীদিগকে বলিলেন; তাহারা ইহা শুনিয়া সকলে একবাক্যে বলিল, চল তবে ফিরিয়া যাই। জনৈক উদারহৃদয় ভদ্রলোক বলিলেন, “তাই ত,পুরুষেরা নদী পার হইয়া কুমীরকে কলা দেখাইয়াছিল,—নারীর আহৃত জ্ঞানে নারীকেই বঞ্চিত করিয়াছিল,—তাহার ফল হাতে হাতে!”

 কনক দ্বীপের উদ্যমশীল বালকেরা উদ্যানের এক কোণে খানিকটা স্থান পরিষ্কার ও | চিহ্নিত করিল, পরে বালিকাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “আইস ভগিনি! তোমরাও যোগদান কর; আমরা কোদালি দ্বারা ভূমি প্রস্তুত করি, তোমরা স্বহস্তে বীজ বপন কর! আজি কি শুভদিন, এখন হইতে আমাদের নিজের গাছ হইবে।” বিস্ময়স্তম্ভিত জিনেরা নীরবে দাড়াইয়া চাহিয়া রহিল, কনকবাসীর এ শুভকার্য্যে তাহারা বাধা দিতে পারিলনা। নব উৎসাহে অণুপ্রাণিত কনকবাসীদের এ মহৎ কার্য্যে—জিন দূরে থাকুক,—দৈত্যও এখন বাধা দিতে অক্ষম!

 অতঃপর কনক দ্বীপ পুনরায় দ্বিগুণ ত্রিগুণ ধনধান্যে পূর্ণ হইল; অধিবাসীগণ পরম সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিল। তাহারা আর কোন প্রকার ইন্দ্রজালে ভুলিবার পাত্র নয়! কারণ এখন ললনাগণ জ্ঞান কাননের অধিষ্ঠাত্রী হইয়াছেন।

‘কনকের রূপ কথা অমৃত সমান,
মৃত ব্যক্তি যদি শুনে পায় প্রাণদান!

নারী-সৃষ্টি
(পৌরাণিক উপাখ্যান)

[কিছুদিন হইল কোন ইংরাজী সংবাদপত্রে নারী-সৃজন সম্বন্ধে একটী চমৎকার কৌতুকপূর্ণ গলশ পাঠ করিয়াছিলাম। আমার ভগিনিদিগকে তাহার বাঙ্গালা অনুবাদ উপহার দিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না। পূর্বেই বলিয়া রাখি, আমি স্কুলের ছাত্রীর ন্যায় শাব্দিক অনুবাদ কবি না—কেবল মূল বিষয়ের মর্ম্মোদ্ধার করিব। সুতরাং কেহ মূলের সহিত অনুবাদের বৈষম্য দেখিয়া হতাশ বা বিরক্ত হইবেন না।]

কর্ণেল ইঙ্গারসোল (Ingersoll) “মুসার ভ্রম” শীর্ষক বক্তৃতা দানকালে নারী-সৃজন বিষয়ক পুরাকালের একটি আখ্যায়িকা বর্ণনা করিতে ভালবাসিতেন। তিনি তারা প্রমাণ করিতে প্রয়াস পাইতেন যে বাইবেলের নারী-সৃষ্টির ইতিহাস অপেক্ষা ঐ প্রাচ্য গল্পের ভাব কত উচ্চ এবং কত উদার। কিন্তু জানি না, তিনি নিম্নলিখিত হিন্দুর পৌরাণিক আখ্যায়িকা শ্রবণ করিলে ইহাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করিতেন কি না।