পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/১৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর : দ্বিতীয় খণ্ড ১৪৫

নীরস হইয়া পড়িয়াছে। আমরা স্মরণ হয়, সে কি সুন্দর! আমরা সম্মুখে নাচিত, গায়িত, খেলিত! মনে পড়ে তাহার সেই কটাক্ষ-মরি মরি! সে কেমন করিয়া আড় নয়নে আমার দিকে চাহিত! সে আমার খেলার সহচরী ছিল; আমার জীবনসঙ্গিনী ছিল! তাহার বিরহ আমার অসহ্য!” ত্বস্তি বিনা বাক্যব্যয়ে তাহাকে পুনরায় সে রমণী প্রদান করিলেন।[১]

 চতুর্থ দিবসে আবার ত্বস্তিদেব দেখিলেন যে পুরুষ বনিতাসমভিব্যাহারে তাহার নিকট আসিতেছে। যাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া পুরুষ বলিল, “দেব! আমায় ক্ষমা করুন; আমি ঠিক বুঝিতে পারি না, নারী আমার আনন্দের কারণ, না, বিরক্তির কারণ। তাহাকে লইয়া আমার সুখশান্তি অপেক্ষা কষ্টের ভাগই অধিক। অতএব প্রভাে! আপনি কৃপাবশতঃ আমাকে ইহা হইতে মুক্তিদান করুন।”

 এবার দেবতা ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “যাও তােমার যাহা ইচ্ছা কর গিয়া!” পুরুষ উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া বলিল,“এ যে আমার কালস্বরূপ, ইহার সহিত জীবন যাপন করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি যে কিছুতেই ইহার সঙ্গে থাকিতে পারি না!” ত্বস্তি উত্তর দিলেন, “তুমি ত ইহাকে ছাড়িয়া থাকিতে পার না!”

 পুরুষ নিরুপায় হইয়া মনের দুঃখে খেদ করিতে লাগিল, “কি আপদ! আমি রমণীকে (এ ভূতের বােঝা?) রাখিতেও চাহি না, ফেলিতেও পারি না!!”

তদবধি নারী অভিশাপরূপে পুরুষের গলগ্রহ হইয়া রহিয়াছে!!!

নার্স নেলী
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত)

আমার ছােট ননদ খুকী তিন বৎসর যাবৎ রােগে ভুগিতেছেন। অবশেষে ডাক্তারের পরামর্শে বায়ু পরিবর্তনের নিমিত্ত লক্ষ্ণৌ আসিয়াছেন। তাঁহার যত্ন করিবার জন্য আমিও সঙ্গে আসিয়াছি। আল্লাহ রাখে, আমাদের কাফেলায় অনেক লােক, খুকীর স্বামী পুত্র প্রভৃতি সকলেই ছিল।

 আমাদের জনৈক বন্ধু হেমবাবুও লক্ষ্ণৌতে ছিলেন। তাঁহার স্ত্রী বিমলা দেবী পীড়িত হইয়া জানানা হাসপাতালে আছেন শুনিয়া, আমি তাহাকে দেখিতে গেলাম। তিনি শয্যাশায়িনী ছিলেন। তাহার বস্ত্র পরিবর্তন করিয়া দেয় নার্স; তাহার বাহুর ক্ষতস্থলে পটি বাধে নার্স। এক কথায়, তাহার সমুদয় কার্য্য নার্সগণই করে। আমি প্রায় দুই ঘণ্টাকাল তথায় ছিলাম, ততক্ষণে বিভিন্ন কার্য্যের জন্য গােটা পাঁচ নার্সকে আসিতে যাইতে দেখিলাম। কিন্তু রক্ত পূর্য পূর্ণ বালতি লইয়া গেল যে নার্সটি, তাহার চেহারাটা আমার চক্ষে যেন কেমন বােধ হইল।

 আমি একদিন অন্তর একদিন হেমবাবুর স্ত্রীকে দেখিতে যাইতাম। সত্য কথা বলিতে কি, বিমলাকে দেখিবার আগ্রহ তত ছিল না; তাঁহার সেই জীর্ণ শীর্ণ রুগ্নকায়া মলিনবদনা— ২৯.


  1. নারীও যেন প্রাণমনহীন, বুদ্ধিবিবেকহীন একটা কাঠের পুতুল বিশেষ—পুরুষ তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিলেও সে নিজেকে অপমানিত বােধ করে নাই, আবার ফিরাইয়া লইতে আসিলেও গৌরব অনুভব করে নাই। ত্বস্তিদেব অবশ্যই জানিতেন, এইরূপ নিৰ্বাক “কাঠের পুতুল” গৃহিণীই পুরুষের বাঞ্ছনীয়া!

রাের ১০