পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/২০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৪ রোকেয়া রচনাবলী
১৮৪

সকল দ্রব্য প্রচুর পরিমাণে ছিল, হস্ত প্রসারণ করিলে যাহা হাতে ঠেকিয়াছে, তাহাই গ্রহণ করিয়াছি। যথা—দন্ত নির্মাণের সময় সর্পের বিষদস্তু আমূল লইয়াছি; হস্ত পদ নখ প্রস্তুত করিতে শার্দুলের সমস্ত নখর লইয়াছি; মস্তিষ্কের কোষসমূহ (cells) পূর্ণ করিবার সময় গর্দভের গোটা মস্তিষ্কটাই ব্যবহার করিয়াছি। নারী সৃজনকালে আমি শুধু অনলের উত্তাপ ইয়াছিলাম; পুরুষের বেলায় একেবারে জ্বলন্ত অঙ্গার লইয়াছি। বাছা! তুমি তাহাই লিখ।”

 বীণা লিখিলেন, (জ্বলন্ত অঙ্গার)।

 ত্বস্তি। বৎসে! মনোযোগ পূর্বক শ্রবণ কর, রমণীর বেলায় আমি তুহিনের শৈত্যটুকু মাত্র লইয়াছিলাম, পুরুষের বেলায় তুষার খণ্ড, এমনকি আস্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা ব্যবহার করিয়াছি। তাহা কি তুমি লিখিয়াছ বীণা?

 বীণা কাগজ দেখাইলেন—(তুষার, কাঞ্চনজঙ্ঘা)।

 শিরিন। আগ্নেয়গিরি বিসুবিয়াস (Vesuvius) এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা যে পাশাপাশি ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাই আমরা পুরুষের নিজের ভাষায়ই পুরুষের বর্ণনা এইরূপ দেখিতে পাই যে এখনই

“জ্বলিল ললাট বহি প্রদীপ্ত শিখায়
বহ্নিময় হৈল সেই শূন্যব্যাপী দেশ,
ধরিল সংহার মৃত্তি, রুদ্র ব্যোমকেশ
গর্জিয়া সংহার শূল করিলা ধারণ।”

 আবার পর মুহুর্তেই (অবশ্য “পার্বতী বাক্যেতে রুদ্র ত্যাজি উগ্রভাব”)—

“সহাস্য বদনে ইন্দ্রে সম্ভাষি কহিলা,
আখণ্ডল, বৃত্রবধ অনুচিত মম।”

 শ্রুতলিপি শেষ হইলে মহাত্মা ত্বস্তি বলিলেন, “দেখ বাছা! তুমি ইহা সহজ ভাষায় লিখিবার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিবে, যেন একটি শব্দ, এমনকি একটি ছেদ পর্য্যন্তও এদিক ওদিক না হয়।”

 বীণা। তাহাই হইবে; আপনি ভাবিবেন না। আমি বেশ স্বাবধানে লিখিব। নচেৎ প্রভুর অত্যন্ত কষ্ট হইবে—এখন ত কেবল পুরুষেরা ডাকাডাকি করে, তখন মেয়েরাও জ্বালাতন করিয়া মারিবে!

 অতঃপর ত্বস্তিদেব বিদায় হইলে সকলে যে যাহার শয্যা আশ্রয় করিলেন। কিন্তু আমি শয়ন করিতে যাইবার সময় কি জানি কিরূপে পড়িয়া গেলাম। সেই পতনে আমি চমকিয়া উঠিলাম। চক্ষু উম্মীলন করিয়া দেখি আমি তখনও সোফায় বসিয়া; গৃহকোণে মোমবাতিটা মিটিমিটি জ্বলিতেছে, আর শিরীন ও বীণা মড়ার সহিত বাজী রাখিয়া ঘুমাইতেছেন! দূরাগত কুক্কুটধ্বনি শ্রবণে বুঝিলাম, রজনীর অবসান হইয়াছে। তবে কি এতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখিতেছিলাম?