পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৪১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অবরোধ বাসিনী ৩৮৭

 ট্রেণ আসিবার সময় জনৈক ইংরাজ কর্ম্মচারীটী ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে হাজী সাহেবকে বলিলেন, “মুন্সি! তোমারা আসবাব হিয়াসে হাটা লো। আভি ট্রেণ আবেগা-প্লাটফরম পর খালি আদামি রহেগা-আসবাব নেহি রহেগা।” হাজী সাহেব যোড়হস্তে বলিলেন, “হুজুর, ঐ সব আসবাব নাহি-আওরত হায়।” কর্ম্মচারিটী পুনরায় একটা “বস্তায়” জুতার ঠোকর মারিয়া বলিলেন, “হা, হা-এই সব আসবাব হাটা লো।” বিবিরা পর্দ্দার অনুরোধে জুতার গুতা খাইয়াও টু শব্দটী করেন নাই।

চার

উড়িষার অন্তর্গত রাজকণিকায় একজন ভদ্রলোক চাকুরী উপলক্ষে ছিলেন। বাসায় তাঁহার মাতা, দুইজন ভগিনী এবং স্ত্রী ছিলেন। বর্ষার সময়। তাঁহার বাঙ্গলায় চারিজন পাখাটানা কুলি পালাক্রমে সমস্ত দিন ও রাত্রি পাখা টানিত। সাহেব “টুরে” বাহিরে গিয়াছেন; রাত্রিকালে তাঁহার স্ত্রীর কামরায় একজন চাকরাণী শুইয়াছিল। তাঁহার ভগিনীগণ অন্য কামরায় ছিলেন।

 সে অঞ্চলে গরমের সময় লোকে বেশী বিছানা ব্যবহার করে না। রাত্রিকালে প্রবল বেগে বৃষ্টি হওয়ায় সাহেবের স্ত্রীর শীত বোধ হইল। তবু তিনি চাকরাণীকে ডাকিয়া পাখা বন্ধ করিতে বলিলেন না। ক্রমে শীত অসহ্য হওয়ার দরি (শতরঞ্জি) ও সুজনী তুলিয়া গায়ে দিলেন। কিন্তু হতভাগা পাখা-কুলী আরও জোরে জোরে পাখা টানিতে লাগিল। তখন অগত্যা বউ বিবি ঐ দরি চাদর সমস্ত গায়ে জড়াইয়া পালঙ্কের নীচে গিয়া শুইলেন।

 পরদিন সকালে একজন চাকরাণী কামরায় ঝাঁটা দিতে আসিয়া পালঙ্কের নীচে সাদা একটা কি দেখিয়া দিল ঝাঁটার বাড়ি-ঝাঁটার চোটে তাড়াতাড়ি বউ বিবি পাশ ফিরিলেন-বেচারী চাকরাণী যেন মরিয়া গেল!


পাঁচ

ই· আই· রেলযোগে কোন বেহারী ভদ্রলোকে সস্ত্রীক পশ্চিমে বেড়াইতে যাইতেছিলেন। তিনি স্ত্রীকে লেডীর কক্ষে না দিয়া নিজেই সঙ্গে রাখিলেন। তাঁহারা সেকেণ্ড কাসের টিকিট লইয়াছিলেন। বেগম সাহেবা বোরকা পরিয়াই রহিলেন। এক সময় সাহেব বাথরুমে থাকিতে ট্রেন কোন ষ্টেশনে থামিল। অপর এক যাত্রী কোথাও স্থান না পাইয়া ঐ কক্ষে উঠিয়া অতি সঙ্কুচিতভাবে বসিয়া একটা জানালা দিয়া মুখ বাহির করিয়া রহিলেন। এদিকে পূর্ব্বোক্ত সাহেব বাথরুম হইতে আসিয়া দেখেন, তাঁহার স্ত্রী অনুপস্থিত! কি করিবেন-তখন চলন্ত ট্রেন! পরবর্ত্তী ষ্টেশনে আগন্তুক নামিয়া গেলেন। আমাদের কথিত সাহেবও নামিয়া ষ্টেশনের পুলিশে সংবাদ দিলেন যে তাঁহার স্ত্রী অমুক ও অমুক ষ্টেশনের মধ্যবর্ত্তী স্থানে হারাইয়াছে।

 বেচারা পুলিশ বিভিন্ন ষ্টেশনে টেলিগ্রাম করিল যে কালো বোরকায় আবৃতা একটি মহিলার খোঁজ কর। একজন কনষ্টেবল বলিল, “একবার এই গাড়ীখানাই ভাল করিয়া খুঁজিয়া দেখি না।” যে বেঞ্চে সাহেব বসিয়াছিলেন, কনষ্টেবল সেই বেঞ্চের নীচে কালো একটা কি দেখিতে