পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৪৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪১০ রোকেয়া রচনাবলী

গঙ্গাস্নান করে আসবেন। কিন্তু, আমার সে কল্পনা আকাশেই থেকে গেল। দেখলাম বেহারা মায় আরদালী দাসী দুইটী-পাল্কী নিয়ে জলের মধ্যে নেমে গেল। যেখানে গিয়ে পাল্কী থামলো, সেখানে বোধ হয় বুক-সমান জল। বেহারারা তখন পাল্কীখানিকে একেবারে জলে ডুবিয়ে তৎণাৎ উপরে তুললো। এবং তারপরেই পাল্কী নিয়ে তীরে উঠে এসে, যেভাবে আগমন, সেইভাবেই প্রতিগমন। আমার হাসি এলো পাল্কীর গঙ্গাস্নান দেখে; আর মনে কষ্ট হ’তে লাগল, পাল্কীর মধ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অবস্থা স্মরণ করে। এই শীতের সন্ধ্যায় পাল্কীর মধ্যে মা-লক্ষ্মীরা ভিজে কাপড়ে হি-হি করে কাঁপছেন। এদিকে তাঁদের স্নান যা হোলো, তা তো দেখতেই পেলাম। এর নাম পর্দ্দা!

 সেন মহাশয় পাল্কীর “গঙ্গাস্নান” দেখিয়া হাসিয়াছেন। আমরা শৈশবে চিলমারীর ঘাটে ‘পাল্কীর ব্রহ্মপুত্র নদের স্নান’ শুনিয়া হাসিয়াছি। পরে ভাগলপুরে গিয়া পাল্কীর রেল ভ্রমণের বিষয় শুনিয়াছি।

 একবার একটি ত্রয়োদশ বর্ষীয়া নব-বিবাহিতা বালিকার শ্বশুর-বাড়ী যাত্রা স্বচক্ষে দেখিয়াছি; তাহা বেশ স্পষ্ট মনে আছে। ভাগলপুর প্রভৃতি স্থানে জুন মাসে রৌদ্র কিরূপ প্রখর হয়, তা সকলেই জানেন।

 জুন মাসে দিবা ৮ ঘটিকার সময় সে বালিকা নববধূকে মোটা বেনারসী শাড়ী পরিয়া মাথায় আধ হাত ঘোমটা টানিয়া পাল্কীকে উঠিতে হইল। সেই ঘোমটার উপর আবার একটা ভারী ফুলের “সেহরা” তাহার কপালে বাঁধিয়া দেওয়া হইল। পরে পাল্কীর দ্বার বন্ধ করিয়া জরির কাজ করা লাল বানাতের ঘেরাটোপ দ্বারা পাল্কী ঢাকা হইল। সেই পাল্কী ট্রেনের ব্রেকভ্যানের খোলা গাড়ীতে তুলিয়া দেওয়া হইল। এই অবস্থায় দগ্ধ ও সিদ্ধ হইতে হইতে বালিকা চলিল, তাহার শ্বশুর-বাড়ী-যশিদী!!

বেয়াল্লিশ

দিন (৭ই জুলাই ১৯৩১ সাল) জনৈকা মহিলা নিন্মলিখিত ঘটনা দুইটি বলিলেনঃ

 বহুবর্ষ পূর্ব্বে তাঁহার সম্পর্কের এক নানিজান পশ্চিম দেশে বেড়াইতে গিয়া ফিরিয়া আসিলেন। তিনি যথাসময়ে টেলিগ্রাফ যোগে তাঁহার কলিকাতায় পৌঁছিবার সময় জানাইয়াছিলেন। কিন্তু সেদিন তুফানে সমস্ত টেলিগ্রাফের তার ছিঁড়িয়া গিয়াছিল এবং কলিকাতার রাস্তায় সাঁতার-জল ছিল। সুতরাং এখানে কেহ নানিজানের টেলিগ্রাফ পায় নাই এবং হাবড়া ষ্টেশনে পাল্কী লইয়া কেহ তাঁহাকে আনিতেও যায় নাই।

 এদিকে যথাসময়ে নানিজানের রিজার্ভ-করা গাড়ী হাবড়ায় পৌঁছিল; সকলে নামিলেন জিনিষপত্রও নামান হইল কিন্তু পাল্কী না থাকায় নানিজান বোরকা পরিয়া থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই নামিতে সম্মত হইলেন না। অনেকক্ষণ সাধ্য-সাধনের পর নানাসাহেব ভারী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “তবে তুমি এই ট্রেনেই থাক, আমরা চলিলাম।” বেগতিক দেখিয়া নানিজান মিনতি করিয়া বলিলেন, “আমি এক উপায় বলিয়া দিই, আপনারা আমাকে সেইরূপে নামান।” উপায়টী এই যে, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গে অনেক কাপড় জড়াইয়া তাঁহাকে একটা বড় গাঁটরীর মত করিয়া বাঁধিয়া তিন চারি জনে সেই গাঁটরী ধরাধরি করিয়া টানিয়া ট্রেণ হইতে নামাইল। অতঃপর তদবস্থায় তাঁহাকে ঘোড়ার গাড়ীতে তুলিয়া দেওয়া হইল।