কিছুই ঠিক করিতে পারিলাম না। আমার বন্ধুরা কিছু বুঝিতে পারিলেন না; কিন্তু যেহেতু বোরকা সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে, তাই আমি অনুসন্ধানে প্রবৃত হইলাম। শেষে দেখি কি, এক বোরকাধারিণী বিবি যাইতেছেন, তাঁহারই বোরকা ভিতর হইতে শিশুর রোদনের শব্দ আসিতেছে!
ঘটনা ছিল এই যে বিবি সাহেবা শিশুকে বোরকা ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন; সে গরমে অস্থির হইয়া চীৎকার করিতেছিল! তাই কেহ শিশুকে দেখিতে পায় নাই, কেবল কান্না শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল। আমি বন্ধুদের ঐ তামাসা দেখাইয়া দিলাম। আর হাসিতে হাসিতে আমাদের যে কি দশা হইল, তাহা আর কি বলিব?
আমি পূর্ব্বের ন্যায় আবার একদা আলীগড় ষ্টেশনের প্ল্যাটফরমে পায়চারি করিতেছিলাম। সম্মুখে এক “সফেদ গোল” (শাদা দল) আসিতে দেখিলাম। নিকটে আসিলে দেখিলাম আগে আগে এক প্রবীণ ভদ্রলোক এক হাতে পানদান অপর হাতে পাখা লইয়া আসিতেছেন; তাঁহার পশ্চাতে কয়েকটী বোরকাধারিণী পরস্পরে জড়াজড়ি করিয়া মিলিত হইয়া আসিতেছেন। এই কাফেলাটী অধিক দূরে না যাইতেই এক মাল-ঠেলা গাড়ীর সম্মুখীন হইল। উহার সহিত টক্কর খাইয়া এক বিবি যেই পড়িলেন, অমনি সমস্ত পার্টি তাঁহার সহিত গড়াইল।
সন্ধ্যার সময়, গাড়ী আসিতেছিল, যাত্রীদের হাঙ্গামা ছিল-এমত স্থলে প্লাটফরমের উপর ঐরূপ আশ্চর্য্য জিনিষ পড়িয়া থাকিতে দেখিলে কে না অগ্রসর হইয়া দেখিবে? অতি শীঘ্র বেশ একটা ভীড় জমা হইল। প্রত্যেকেই ভূপতিতাদের সাহায্য করিতে ইচ্ছুক ছিল; কিন্তু স্ত্রীলোককে স্পর্শ করিবে কে? সঙ্গের বৃদ্ধ ভদ্রলোকটীর জন্য আরও দুঃখ হইতেছিল; বেচারা একা, আর এই বিপদ! শেষে আমি বলিলাম, “হযরত! আপনিই উহাদের তুলুন না; দেখুন তো বিবিদের কোথাও আঘাত লাগে নাই ত?”
বেচারা যখন তাঁহাদের তুলিতে লাগিলেন, আমি দেখিলাম যে বিবিরা আপন আপন বোরকা পরস্পরের বোরকা সহিত বাঁধিয়া লইয়াছিলেন এবং অগ্রবর্ত্তিনীর বোরকার দামন ধরিয়া সকলেই চক্ষু বুজিয়া চলিতেছিলেন। এখন আমার সম্মুখে এই সমস্যা ছিল যে অগ্রবর্ত্তিনী বিবি এই মাল-ঠেলা গাড়ী দেখিলেন না কেন, যে এ বিপদের সম্মুখীন হইতে হইল? আমি তাঁহার বোরকার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলাম যে তাঁহার বোরকার জাল যাহা চক্ষের সম্মুখে থাকা চাই, তাহা মাথার উপর পিছন সরিয়া গিয়াছে। ইহাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হইল যে বিবি সাহেবা কেবল আন্দাজে হাঁটিয়া আসিতেছিলেন।
এখন অবস্থা এই হইয়া দাঁড়াইল যে বেচারা “বড়ে মিয়াঁ” একজনকে উঠাইতে গেলে অপর সকলের উপর টান পড়ে-সুতরাং প্রথম বিবি আবার সেই টানে “বড়ে মিয়াঁর” হাত ছাড়া হইয়া যান। এইরূপে অনেক টানাহেঁচড়ার পরে বিবিরা উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিলেন।
কবির ভাষায় বলিতে ইচ্ছা করেঃ
“কাব্য উপন্যাস নহে, এ মম জীবন,
নাট্যশালা নহে, ইহা প্রকৃত ভবন!”