পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর:প্রথম খণ্ড ২৭

 কিন্তু কলিযুগে আমাদের ন্যায় অর্ধাঙ্গী লইয়া পুরুষগণ কিরূপ বিকলাঙ্গ হইয়াছেন, তাহা কি কেহ একটু চিন্তাচক্ষে দেখিয়াছেন? আক্ষেপের (অথবা “প্রভুদের সৌভাগ্যের বিষয় যে, আমি চিত্রকর নহি নতুবা এই নারীরূপ অৰ্দ্ধাঙ্গ লইয়া তাহাদের কেমন অপরূপ মূর্তি হইয়াছে, তাহা আঁকিয়া দেখাইতাম॥

 শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ বলেন যে, আমাদের সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায় ঐ শকটের এক চক্র পতি, অপরটি পত্নী। তাই ইংরাজী ভাষায় কথায় কথায় স্ত্রীকে অংশিণী “partner") উত্তমার্ধ (better half) ইত্যাদি বলে। জীবনের কর্ত্তব্য অতি গুরুতর, সহজ নহে:

“সুকঠিন গার্হস্থ্য ব্যাপার
সুশৃখলে কে পারে চালাতে?
রাজ্যশাসনের রীতি নীতি
সূক্ষ্মভাবে রয়েছে ইহাতে।”

 বােধ হয় এই গার্হস্থ্য ব্যাপারটাকে মস্তকস্বরূপ কল্পনা করিয়া শাস্ত্রকারগণ পতি ও পত্নীকে তাহার অঙ্গস্বরূপ বলিয়াছেন। তবে দেখা যাউক বর্ত্তমান যুগে সমাজের মূর্ত্তিন কেমন

 মনে করুন কোন স্থানে পূর্বদিকে একটি বৃহৎ দর্পণ আছে, যাহাতে আপনি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে পারেন। আপনার দক্ষিণাঙ্গভাগ পুরুষ এবং বামাঙ্গভাগ স্ত্রী। এই দর্পণের সম্মুখে দাড়াইয়া দেখুন:

 আপনার দক্ষিণ বাহু দীর্ঘ (ত্রিশ ইঞ্চি) এবং সুল, বামবাহু দৈর্ঘ্যে চবিবশ ইঞ্চি এবং ক্ষীণ। দক্ষিণ চরণ দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি, বাম চরণ অতিশয় ক্ষুদ্র। দক্ষিণ স্কন্ধ উচ্চতায় পাঁচ ফিট, বাম স্কন্ধ উচ্চতায় চারি ফিট! তবেই মাথাটা সােজা থাকিতে পারে না, বাম দিকে ঋকিয়া পড়িতেছে। কিন্তু আবার দক্ষিণ কর্ণর্ভারে বিপরীত দিকেও একটু ঝুঁকিয়াছে!) দক্ষিণ কর্ণ হস্তিকর্ণের ন্যায় বৃহৎ, বাম কর্ণ রাসভকর্ণের ন্যায় দীর্ঘ! দেখুন!—ভাল করিয়া দেখুন, আপনার মূর্তিটা কেমন!! যদি এ মূর্তিটা অনেকের মনােমত না হয়, তবে দ্বিচক্র শকটের গতি দেখাই। যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছােট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না।

 সমাজের বিধি ব্যবস্থা আমাদিগকে তাহাদের অবস্থা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়াছে; তাহাদের সুখ দুঃখ এক প্রকার, আমাদের সুখ দুঃখ অন্য প্রকার। এস্থলে বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নবদম্পতীর প্রেমালাপ কবিতার দুই চারি ছত্র উদ্ধৃত করিতে বাধ্য হইলাম—

 “বর। কেন সখি কোণে কাদিছ বসিয়া?
 “কনে। পুষি মেনিটিরে ফেলিয়া এসেছি ঘরে।


 “বর। কি করিছ বনে কুঞ্জভবনে?
 “কনে। খেতেছি বসিয়া টোপা কূল।