পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০ রোকেয়া রচনাবলী

করা যায় না, বালিকাদের বিদ্যালয় সংখ্যায় পাওয়াই যায় না! যে স্কুলে ভ্রাতা “শমস-উলওলামা”[১] সেস্থলে ভগিনী “নজম-উল-ওলামা হইয়াছেন কি? তাহাদের অন্তঃপুর গগনে; অসংখ্য “নজমন্নেসা” “শমূসন্নেসা” শোভা পাইতেছেন বটে। কিন্তু আমরা সাহিত্য-গগর্মে “নজম-উ-ওলামা” দেখিতে চাই।

 আমাদের জন্য এদেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপ— প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কোরাণ শরীফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলির অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না, কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যে টীয়াপাখীর মত আবৃত্তি কর। কোন পিতার হিতৈষণার মাত্রা বৃদ্ধি হইলে, তিনি দুহিতাকে “হাফেজা” করিতে চেষ্টা করেন। সমুদয় কোরাণখানি যাহার কণ্ঠস্থ থাকে, তিনিই “হাফেজ।” আমাদের আরবী শিক্ষা ঐ পর্য্যন্ত! পারস্য এবং উর্দ শিখিতে হইলে, প্রথমেই “করিমা বখশা এবর হালেমা” এবং একেবারে (উর্দু) “বানাত নাশ” পড়![২] একে আকার ইকার নাই, তাতে আবার আর কোন সহজপাঠ্য পুস্তক পূর্বে পড়া হয় নাই সুতরাং পাঠের গতি দ্রুতগামী হয় না। অনেকের ঐ কয়খানি পুস্তক পাঠ শেষ হওয়ার পূর্বেই কন্যা-জীবন শেষ হয়। বিবাহ হইলে বালিকা ভাবে, “যাহা হোক, পড়া হইতে রক্ষা পাওয়া গেল!” কোন কোন বালিকা রন্ধন ও সূচীকর্ম্ম সুনিপুণা হয়। বঙ্গদেশেও বালিকাদিগকে রীতিমত বঙ্গভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না। কেহ কেহ উর্দু পড়িতে শিখে, কিন্তু কলম ধরিতে শিখে না। ইহাদের উন্নতির চরম সীমা সমা চুমকির কারুকার্য্য, উলের জুতা মোজা ইত্যাদি প্রস্তুত করিতে শিক্ষা পর্যন্ত।

 যদি ধর্মগুরু মোহাম্মদ (দঃ) আপনাদের হিসাব নিকাশ লয়েন যে, “তোমরা কন্যার প্রতি কিরূপ ন্যায় ব্যবহার করিয়াছ?” তবে আপনারা কি বলিবেন?

 পয়গম্বরদের ইতিহাসে শুনা যায়, জগতে যখনই মানুষ বেশী অত্যাচার অনাচার করিয়াছে, তখনই এক-একজন পয়গম্বর আসিয়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করিয়াছেন। আরবে স্ত্রীজাতির প্রতি অধিক অত্যাচার হইতেছিল; আরববাসিগণ কন্যাহত্যা করিতেছিল, তখন হজরত মোহাম্মদ (দঃ) কন্যাকুলৈর রক্ষকস্বরূপ দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন। তিনি কেবল বিবিধ ব্যবস্থা দিয়াই ক্ষান্ত থাকেন নাই, স্বয়ং কন্যা পালন করিয়া আদর্শ


  1. “গমস্-উল-ওলামা”, পণ্ডিতদের উপাধি বিশেষ। ঐ শব্দগুলির অনুবাদ এইরূপ হয় শসল, $un; ওলামা, ("আলম” শব্দের বচন) leared men, এইরূপ নম্-উল-ওলামা অর্থে the star of the learned men (or women!) বুঝিতে হইবে।
  2. এইখানে একটি দশম বর্ষের বালিকার গল্প মনে পড়িল। পল্লীগ্রামে অনেকের বাড়ী ধান ভানিবার জন্য “ভানানী” নিযুক্ত হয়। সেই বালিকা “বানাতন নাশ” পড়িতে যাইয়া হোসেন আরার মেজাজের বর্ণনাটা হৃদয়ঙ্গম করা অপেক্ষা ভালানীদের ধানভানা কাটা সহজ মনে করিত। তাই সুযোগ পাইলেই সে টেকিশালে গিয়া দুই এক সের ধান্যের শ্রাদ্ধ করি! সে ধান্য হইতে তুকূল পরিষ্কার পাওয়া যাইত না- তাহা “Whole meal” ময়দার ন্যায় ধান্যষ-তল মিশ্রিত এক প্রকার অদ্ভুত সামগ্রী হইত। যে রোগীদের ঐন্য হোলমিল ময়দার ব্যবস্থা দেওয়া হয়, তাঁহাদের জন্য উক্র হোল-মিলতুলচুর্ণ অবশ্যই উপকারী খাদ্য, সন্দেহ নাই!!