দিই, তখন থেকে সে গানের সুরগুলি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার ছাত্রের। তার পর আমি যদি গাইতে যাই তারা এ কথা বলতে সংকোচমাত্র করে না যে, আমি ভুল করছি। এ সম্বন্ধে তাদের শাসন আমাকে বারবার স্বীকার করে নিতে হয়।
কবিতা কয়টি যে আমারই সেও আমি স্বীকার করে নিলেম। পড়ে বিশেষ তৃপ্তি বোধ হল— মনে হল ভালোই লিখেছি। বিস্মরণশক্তির প্রবলতা-বশত নিজের কবিতা থেকে নিজের মন যখন দূরে সরে যায় তখন সেই কবিতাকে অপর সাধারণ পাঠকের মতোই নিরাসক্তভাবে আমি প্রশংসা এবং নিন্দাও করে থাকি। নিজের পুরোনো লেখা নিয়ে বিস্ময় বোধ করতে বা স্বীকার করতে আমার সংকোচ হয় না— কেননা, তার সম্বন্ধে আমার অহমিকার ধার ক্ষয় হয়ে যায়। পড়ে দেখলাম—
তোমারে ভুলিতে মোর হল না যে মতি,
এ জগতে কারো তাহে নাই কোনো ক্ষতি।
আমি তাহে দীন নাহি, তুমি নহ ঋণী,
দেবতার অংশ তাও পাইবেন তিনি।
নিজের লেখা জেনেও আমাকে স্বীকার করতে হল যে, ছোটোর মধ্যে এই কবিতাটি সম্পূর্ণ ভরে উঠেছে। পেটুকচিত্ত পাঠকের পেট ভরাবার জন্যে একে পঁচিশ-ত্রিশ লাইন পর্যন্ত বাড়িয়ে তোলা যেতে পারত— এমন-কি, একে বড়ো আকারে লেখাই এর চেয়ে হত সহজ। কিন্তু লোভে পড়ে একে বাড়াতে গেলেই একে কমানো হত। তাই নিজের অলুব্ধ কবিবুদ্ধির প্রশংসাই করলেম।
তার পরে আর-একটা কবিতা—
ভোর হতে নীলাকাশ ঢাকে কালো মেঘে,
ভিজে ভিজে এলোমেলো বায়ু বহে বেগে।
কিছুই নাহি যে হায় এ বুকের কাছে—
যা-কিছু আকাশে আর বাতাসেতে আছে।
আবার বললেম, শাবাশ! হৃদয়ের ভিতরকার শূন্যতা বাইরের আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ করে হাহাকার করে উঠছে একথাটা এত সহজে এমন সম্পূর্ণ করে বাংলা সহিত্যে আর কে বলেছে? ওর উপরে আর একটি কথাও যোগ করবার জো নেই। ক্ষীণদৃষ্টি পাঠক এতটুকু ছোটো কবিতার সৌন্দর্য দেখতে পাবে না জেনেও আমি যে নিজের লেখনীকে সংযত করেছিলেম এজন্যে নিজেকে মনে মনে বলতে হল, ধন্য!
তার পরে আর-একটি কবিতা—
আকাশে গহন মেঘে গভীর গর্জন,
শ্রাবণের ধারাপাতে প্লাবিত ভুবন।
৩