পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (নবম সম্ভার).djvu/৪১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শরৎ-সাহিত্য-সংগ্ৰহ নিত্য উপাসিত, তাহারই ছায়া শ্রীরাধার হৃদয়-মন অধিকার করিয়া রাখিয়াছিল। অন্তের তাঁহাতে স্থান হয় না, তাঁহাই সদানন্দের অশ্রজলের কারণ, আকর, মূল— কিন্তু সোপান বা পথ নহে। অগাধ সমুদ্র বাবাতের সহিত যুদ্ধ করে, কিন্তু ঘোষণা করিয়া বেড়ায় না। শুধু ক্ষুদ্র তরঙ্গের দল তটপ্রান্তে আসিয়া ঘাতপ্রতিঘাতে পৃথিবীর বক্ষস্থল পৰ্য্যন্ত কম্পিত করিয়া বলিয়া যায়—“দেখ আমাদের কত প্রতাপ * কুপের জল তাহ পারে না। সাগর-উরি ইহাই গৰ্ব্ব যে, সে অগাধ শক্তিশালী সমুদ্রের আশ্রিত। স্বৰ্য্যের তেজ জননী বসুমতী প্রতিফলিত করেন, তাই তাহার রুদ্র প্রতাপ বুঝিতে পারি। আর সেই অনন্ত জ্যোতিৰ্ম্ময়ী বিশ্বপ্লাবিনী রাধাপ্রেমের কথা বৃন্দ, ললিতা, বিশাখ, প্রভৃতি সখিবৃন্দ ব্যতীত আর কেহ জানিত না । যাহারা জানিতে পারিয়াছিল তাহারা মহৎ হইয়াছিল, যাহারা শুনিয়াছিল তাহারা ধন্ত হইয়াছিল। তার পর কালক্রমে লোকে হয়ত সে-কথা ভুলিয়া যাইত। একেবারে না ভুলিলেও তাহাতে এমন জীবন্ত মোহিনী শক্তি থাকিত না। এ মাধুরী যাহারা ধরিয়া রাখিয়াছেন, এ মহৰ নশ্বর জগতের এ-সার বস্তু র্যাহারা পৃথিবীর স্তায় প্রতিফলিত করিয়া জনসাধারণকে উচ্চে তুলিয়াছেন,—তাহার, ঐ অজর চিরপ্রিয় বৈষ্ণব কবিগণ । সে-রাধাপ্রেমের ছায়া তাহার হৃদয়ে ধরিতে পারিয়াছিলেন এবং সরস প্রেমপূর্ণ সুধামাখা ছন্দোবন্ধে জগৎসমক্ষে প্রতিভাত করিয়াছিলেন । স্বৰ্গীয় বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর কহিয়াছেন—“এ জগতে বিশেষণের বাহুল্য' । এ-কথা বড় সত্য। বিশেষণ না থাকিলে বিশেষ্যকে কে চিনিত ! তাই মনে হয় এই অমর কবিতাগুলি রাধাপ্রেমের বিশেষণ ভিন্ন আর কিছুই নহে। যাহাকে দেখিলে তাহার বিশেষ্যকে মনে পড়ে, বিশেষ্যের সেইটিই বিশেষণ, সেইটিই প্রতিবিম্ব, সেইটিই ছায়া । যে বিরহ—শোকগাথা গাহিয়া অতীত দিবসের বৈষ্ণব-কবিগণ আপামর সকলকে উন্মত্ত করিয়াছিলেন, তাহারই একটি হস্তপদহীন পরিত্যক্ত মৃৎপুত্তলিকার মত, মৃত-পুত্রের ছায়ার মত, এই ক্ষুদ্র যমুনা-পুলিনে বসে কাদে রাধা বিনোদিনী’ পদটী সদানন্দের অশ্রু টানিয়া আনিতে সক্ষম হইয়াছিল। ক্ষুদ্র কবির ইহাই গৌরব,-ক্ষুদ্র কবিতার ইহাই মহত্ব। ক্ষুদ্র ছায়া সদানন্দকে বশ করিতে পারিবে, কিন্তু রোহিণীকুমারের নিকটেও হয়ত যাইতে পরিবে না। তাহাতে ছায়ার অপরাধ কি ? মলিন বর্ষার দিনে আকাশের গায় নিবিড় জলদজাল বায়ুভরে চালিত হইতে দেখিলে মনে পড়ে সেই যক্ষের কথা। মনে হয় আজিও বুঝি তেমনি করিয়া উন্মত্ত যক্ষ ঐ মেঘপানে চাহিয়া প্রণয়িনীর সহিত কথা কহিতে চাহিতেছে। স্মরণ হয়, যেন যক্ষ-বধুর বিরহক্লিষ্ট স্নান মুখশোভা কোথায় কোন মায়ার দেশে দেখিয়া আসিয়াছি। 8 ο $