পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (পঞ্চম সম্ভার).djvu/৩১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শরৎ-সাহিত্য-সংগ্রহ

 এবার তিনি জাঁকিয়া আসিয়া দেশে বসিলেন। কাজে কাজেই আমার বিশেষ খোঁজ হইল। দুই-চারি দিবসের আলাপেই তিনি আমাকে এরূপ বশীভূত করিয়া ফেলিলেন যে, তাঁহাকে দেখিলেই আমার ভয় হইত, মুখ শুকাইয়া যাইত, বুক ধড়াস্ ধড়াস্ করিত—যেন কত দোষই করিয়াছি, কত শাস্তি পাইব। আর যথার্থ আমি তখন প্রায়ই দোষী থাকিতাম। সর্ব্বদা একটা না একটা অন্যায় করা আমার চাই। দুই-চারটি অকর্ম্ম, দুই-চারিবার উপদ্রব করা আমার নিত্যকর্ম্ম। ভয় করিলেও আমি দাদাকে বড় ভালবাসিতাম। ভাই ভাইকে যে এত ভালবাসিতে পারে, পূর্ব্বে আমি তাহা জানিতাম না। তিনিও আমাকে বড় ভালবাসিতেন। তাঁর কাছেও কত দোষ করিয়াছি, কিন্তু কিছু বলিতেন না; আর বলিলেও মনে করিতাম, সেজদাদা ত, একটু পরে তার কিছুই মনে থাকিবে না।

 ইচ্ছা করিলে হয়ত তিনি আমার চরিত্র সংশোধন করিতে পারিতেন, কিন্তু কিছুই করিলেন না। তাঁর দেশে আসাতে আমি পূর্ব্বের মত স্বাধীন নয় বটে, কিন্তু তথাপি যাহা আছি, বেশ আছি।

 রোজ ঠাকুর্দ্দার এক পয়সার তামাক খাইয়া ফেলি। বুড়ো বেচারী আমার ভয়ে খাটের খুরোর পাশে, তক্তাপোশের পেটের সিন্দুকে, চালার বাতায়, যেখানে তামাক রাখিতেন, আমি খুঁজিয়া খুঁজিয়া সবটুকু টানিয়া আনিয়া খাইয়া ফেলিতাম। খাইদাই ঘুড়ি ওড়াই, বেশ আছি। কোন জঞ্জাল নাই; পড়া-শুনা একরকম ছাড়িয়াই দিয়াছি। পাখী মারিতাম, কাঠবিড়াল মারিয়া পোড়াইয়া খাইতাম, বনে বনে গর্ত্তে গর্ত্তে খরগোস খুঁজিয়া বেড়াইতাম, কোনও ভাবনা ছিল না।

 বাবা বক্সারে চাকুরি করিতেন। সে-স্থান হইতে আমাকে দেখিতেও আসিতেন না, মারিতেও আসিতেন না। ঠাকুরমা ও ঠাকুর্দ্দার হাল পূর্ব্বেই বিবৃত করিয়াছি। সুতরাং এক কথায় আমি বেশ ছিলাম।

 একদিন দুপুরবেলা বাড়ি আসিয়া ঠাকুরমার নিকট শুনিলাম, আমাকে সেজদার সহিত কলিকাতায় থাকিয়া পড়া-শুনা করিতে হইবে। আহারাদি সমাপ্ত করিয়া একছিলিম তামাক হাতে করিয়া আসিয়া ঠাকুর্দ্দাকে বলিলাম, আমাকে কলকাতায় যেতে হবে? ঠাকুর্দ্দা বলিলেন, হ্যাঁ। আমি পূর্ব্ব হইতেই ভাবিয়া রাখিরাছিলাম, এ-সকল ঠাকুর্দ্দার চালাকি। বলিলাম, যদি যেতে হয় আজই যাব। ঠাকুর্দ্দা হাসিয়া বলিলেন, সে জন্য চিন্তা কি দাদা? রজনী আজই কলকাতায় যাবে। বাসা ঠিক হয়ে গেছে, আজই যেতে হবে। আমি অগ্নিশর্ম্মা হইয়া উঠিলাম। একে সেদিন ঠাকুর্দ্দার তামাক খুঁজিয়া পাই নাই—যে একছিলিম পাইয়াছিলাম, তাহাতে আমার একটানও হইবে না—তাহার উপর আবার এই কথা। ঠকিয়া গিয়াছি; নিজে নিমন্ত্রণ লইয়া আর ফিরান যায় না। কাজেই সেদিন আমাকে কলিকাতায়

৩১২