পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (পঞ্চম সম্ভার).djvu/৩২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাল্য-স্মৃতি

কি করিয়া চিমনী খুলি! কি করিয়া ভিতরের কল দেখি! অনেক নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিলাম, অনেকবার ঘুরাইবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কিছুতেই খুলিল না। পরে দেখিলাম, নীচে একটা ইস্ক্রু আছে, অগত্য সেটা ঘুরাইলাম। কিছুক্ষণ ঘুরাইবার পর হঠাৎ একেবারে ল্যাম্পের আধখানা খসিয়া আসিল। তাড়াতাড়ি ভাল ধরিতে পারিলাম না, উপরের কাচগুলা টেবিল হইতে নীচে পড়িয়া একেবারে চুর্ণ হইয়া গেল।

 সেদিন অনেক রাত্রে আমি বেড়াইয়া আসিলাম। বাসায় আসিয়া দেখিলাম একটা প্রকাণ্ড হৈ-চৈ কাণ্ড বাধিয়া উঠিয়াছে। গদাধরকে মাঝখানে লইয়া সকলে গোল হইয়া বসিয়াছেন। সেজধাধা অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়াছেন। গদাধরের জেরা চলিতেছে।

 গদাধরের চক্ষু দিয়া টস্‌টস্ করিয়া জল পড়িতেছে। বলিতেছে, বাবু, আমি ওটা ছুঁয়েছিলাম বটে, কিন্তু ভাঙ্গিনি, সুকুমারবাবু আমাকে দেখালেন—আমিও দেখলাম। তার পর তিনিও বেড়াতে গেলেন, আমিও রাঁধতে গেলাম।

 কেহই তাহার কথা বিশ্বাস করিল না। সাব্যস্ত হইয়া গেল, সে-ই চিমনি ভাঙ্গিয়াছে। তাহার মাহিনী বাকি ছিল; সেই টাকা হইতে সাড়ে তিন টাকা দিয়া আবার নূতন চিমনি আসিল। সন্ধ্যার সময় যখন আলো জ্বলিল; তখন সকলেই বেশ প্রফুল্প হইল, শুধু আমার চক্ষু দুটাে জ্বালা করিতে লাগিল। সর্ব্বদা মনে হইতে লাগিল, তাহার সাড়ে তিন টাকা চুরি করিয়া লইয়াছি। আর থাকিতে পারিলাম না। কাঁদিয়া কোনও মতে সেজদাদার মত করিয়া বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলাম। মনে করিয়াছিলাম, ঠাকুরমার নিকট হইতে টাকা আনিয়া গোপনে সাড়ে-তিন টাকার পরিবর্ত্তে গদাধরকে সাত টাকা দিব। আমার নিজের কাছে তখন টাকা ছিল না। সব টাকা সেজদাদার নিকট ছিল। কাজেই টাকা আনিতে আমাকে দেশে আসিতে হইল। মনে করিয়া আসিয়াছিলাম একদিনের অধিক থাকিব না। কিন্তু তাহা ঘটিয়া উঠিল না। সাত-আট দিন দেশে কাটিয়া গেল।

 সাত-আট দিন পরে আবার কলিকাতার বাসায় ঢুকিলাম। ঢুকিয়াই ডাকিলাম, গদা! কেহ উত্তর দিল না। আবার ডাকিলাম, গদাধর ঠাকুর। কোনও উত্তর নাই। গদা! এবার রামচরণ আসিয়া বলিল, ছোটবাবু, কখন এলেন?

 এই আসচি—ঠাকুর কোথায়?

৩১৭