পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৪৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬৮ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত চতুর্থ ভাগ দুর্গাপ্রসাদ মনে মনে হরিনাম করেন ও সকলের আজ্ঞাতে শিক্ষাগুরুরূপিনী মনোমোহিনীকে যেরূপেই হউক, প্রত্যহ দূর হইতে একবার দর্শন করিয়া মনে মনে প্রণাম করিয়া আসেন। এদিকে নিজভাব গোপনের জন্য বাসনের কাজ কৰ্ম্মে অধিকতর মনোযোগ দিলেন। এই সময়ে দুর্গাপ্রসাদ নিজ হৃদয় অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেন যে, তাহার হৃদয়ে তখনও বাসনা রহিয়াছে কাম ক্রোধ স্থান পাইতেছে। এ সকল থাকা পৰ্য্যন্ত কিছুতেই অগ্রসর হওয়া যায় না। কিন্তু এ সব যাইবে কিরূপে? নাম, একমাত্র হরিনাম গ্রহণই তিনি এ রোগের মহৌষধ বলিয়া বিবেচনা করিলেন। দুর্গাপ্রসাদ দিবারাত্রি অবিচ্ছেদে নাম লইতে সঙ্কল্প করিলেন। দিবসে কোন বাধা হয় না, কাজ করেন ও মনে মনে নাম লয়েন, কিন্তু রাত্রে নিদ্রার জন্য তাহা হইয়া উঠে না! তখন নিদ্রার সহিত তাহার যুদ্ধ আরম্ভ হইল। নিদ্ৰা দূর করিবার উদ্দেশ্যে তিনি সারারাত্রি ব্যাপিয়া হাতুড়ীতে ধাতু পিটিতে আরম্ভ করেন ও ইহাতে অনেকটা কৃতকাৰ্য হন। কৰ্ম্মানুরোধে নিদ্ৰা আসিত না এবং কয়েক দিনে তাহা একরূপ অভ্যাস হইয়া যায়। প্রভাতের পূৰ্ব্বে একঘন্টা কি অৰ্দ্ধঘন্টা মাত্র বসিয়া হাঁটুতে মাথা রাখিতেন, ইহাতেই একটু মাত্র নিদ্রাবেশ হইত। এইরূপে নিদ্ৰা কমিয়া গেলে প্রায় অবিচ্ছেদে নাম লওয়া চলিতে লাগিল। এই সময় হইতে তিনি একবেলা স্বহস্তে পাক করিয়া আহার করিতে আরম্ভ করেন। এক বৎসর এইরূপ ভাবে গেল; একবৎসরের পরিশ্রমে, পাইকারী দরে সস্তায় বাসন বিক্রয় করিয়াও তাহার হাতে ৫০০ টাকা জমা হইল। এই টাকা হইতে তিনি ১০০ টাকা দীক্ষাগুরুকে ও পুরোহিতকে, ১০০ টাকা শিক্ষা গুরুকে এবং বাকি ৩০০ টাকা ভ্রাতৃস্তে অর্পণ করিলেন। জ্যেষ্ঠকে বলিলেন “ভাই, আমার দ্বারা সংসারের কিছু হইবে না, সম্পত্তি তোমাদেরই রহিল, দিনান্তে একমুষ্টি তণ্ডুল ব্যতীত আমি আর কিছু চাহি না ।" এই দিনই সকলে জানিল যে মনোমোহিনীকে তিনি শিক্ষা গুরুরূপে দর্শন করেন; মনোমোহিনীও তাহা সেই দিনই জানিতে পারিলেন। এই সময় দুর্গাপ্রসাদের বয়স ২৪ বৎসরের অধিক নহে, এই সময় হইতে দৈনিক একমুষ্টি মাত্র করিয়া অন্নাহার করিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু এক দুৰ্ব্বিপাক উপস্থিত হইল, পূৰ্ব্বে কৰ্ম্মের ঝোকে নিদ্ৰা আসিত না, সারারাত্র হরিনাম করিতে পারিতেন। এক্ষণে কৰ্ম্মত্যাগ করায় কতক রাত্র পরেই নিদ্রা উপস্থিত হইতে লাগিল । তিনি নিদ্রা তাড়াইতে কখন কখন উঠিয়া দৌড়িতেন, কখন কখন বা জলে নামিতেন। শীতে গায়ে কাপড় দিতেন না, যে গৃহে থাকিতেন তাহার চালে এক গাছি বড় শিকা খাটাইয়া সেই শিকায় এইজন্য উঠিয়া বসিতেন ও ঝুলিতেন; পড়িবার ভয়ে নিদ্ৰা দূর হইত। এইরূপে আর বৎসর গেল। ইহার পর আহার ত্যাগই ইন্দ্রিয় দমনের শ্রেষ্ঠ উপায় বলিয়া মনে করিলেন এবং দিন দিন অন্তর একবেলা আহারের বন্দোবস্ত করিলেন। ইহাও অভ্যস্ত হইয়া গেল, কিন্তু তাহাতে দেহযষ্টি একেবারে ক্ষীণ হইয়া পড়িল । এইরূপে আরও এক বৎসর কাল অতীত হইল, তৎপর তাহার এক বিধবা মাসী বহু অনুরোধে তাহার পাক প্রস্তুত করিয়া দিবার ভার গ্রহণ করেন। অবিশ্রান্ত হরিনাম লইতে হইত বলিয়া তাহার লোকের সহিত আলাপের সময় ছিল না, লোকের সহিত আলাপ করিতেন না; শেষটা আলাপের ইচ্ছাই হইত না । এইরূপে আলাপ বন্ধ থাকিতে থাকিতে অবশেষে শব্দ উচ্চারণের শক্তি দূর হইল, বাক্য কখন বন্ধ হইয়া গেল। তখন আর ইচ্ছা করিয়াও আলাপ করিতে পারিতেন না, জিহবায় জড়তা বশতঃ শব্দ উচ্চারিত হইত না। এইরূপ অবস্থা ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্য জ্ঞান—স্নানাহারের ইচ্ছা প্রভৃতিও দূর হইতে লাগিল। তখন হইতে নাম স্বতঃ ফুরিত হইত; নাম তখন অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে,—সতত