পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শকুন্তলা
১১৫

অন্যত্র তাহার পরিচয় আছে— আর এই আশ্রমপালিতা বালিকার অনভিজ্ঞতা ও সরলতা বড়োই সুকুমার ও সকরুণ। হায়, মৃগটি যেমন কাতরবাক্যে রক্ষণীয়, শকুন্তলাও তেমনি। যৌ অপি অত্র আরণ্যকৌ।

 মৃগের প্রতি এই করুণাবাক্যের প্রতিধ্বনি মিলাইতেই দেখি, বল্কল-বসনা তাপসকন্যা সখীদের সহিত আলবালে জলপূরণে নিযুক্ত, তরুসোদর ও লতা-ভগিনীদের মধ্যে তাহার প্রাত্যহিক স্নেহসেবার কর্মে প্রবৃত্ত। কেবল বল্কলবসন নহে, ভাবে ভঙ্গীতেও শকুন্তলা যেন তরুলতার মধ্যেই একটি। তাই দুষ্যন্ত বলিয়াছেন:

অধর কিসলর-রাঙিমা-আঁকা,
যুগল বাহু যেন কোমল শাখা,
হৃদয়লোভনীয় কুসুম হেন
তনুতে যৌবন ফুটেছে যেন।

 নাটকের আরম্ভেই শান্তিসৌন্দর্যসংবলিত এমন একটি সম্পূর্ণ জীবন, নিভৃত পুষ্পপল্লবের মাঝখানে প্রাত্যহিক আশ্রমধর্ম, অতিথিসেবা, সখীস্নেহ ও বিশ্ববাৎসল্য লইয়া আমাদের সম্মুখে দেখা দিল। তাহা এমনি অখণ্ড এমনি আনন্দকর যে আমাদের কেবলই আশঙ্কা হয়, পাছে আঘাত লাগিলেই ইহা ভাঙিয়া যায়। দুষ্যন্তকে দুই উদ্যত বাহু দ্বারা প্রতিরোধ করিয়া বলিতে ইচ্ছা হয়, বাণ মারিয়ো না, মারিয়ো না— এই পরিপূর্ণ সৌন্দর্যটি ভাঙিয়ো না

 যখন দেখিতে দেখিতে দুষ্যন্তশকুন্তলার প্রণয় প্রগাঢ় হইয়া উঠিতেছে তখন প্রথম অঙ্কের শেষে নেপথ্যে অকস্মাৎ আর্তরব উঠিল, “ভো ভো তপস্বীগণ, তোমরা তপোবনপ্রাণীদের রক্ষার জন্য সতর্ক হও। মৃগয়াবিহারী রাজা দুষ্যন্ত প্রত্যাসন্ন হইয়াছেন।”

 ইহা সমস্ত তপোবনভূমির ক্রন্দন— এবং সেই তপোবনপ্রাণীদের মধ্যে শকুন্তলাও একটি। কিন্তু কেহ তাহাকে রক্ষা করিতে পারিল না।