পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মনুষ্য
১৮১

করিতে পারিবে কেন। তুমি যে মনে করিতেছ, আমি তোমাকে বেশি বলাইয়াছি, তাহা ঠিক নহে— আমি বরং তোমাকে সংক্ষেপ করিয়া লইয়াছি— তোমার লক্ষ লক্ষ কথা, লক্ষ লক্ষ কাজ, চিরবিচিত্র আকার-ইঙ্গিতের কেবলমাত্র সারসংগ্রহ করিয়া লইতে হইয়াছে। নহিলে, তুমি যে-কথাটি আমার কাছে বলিয়াছ ঠিক সেই কথাটি আমি আর কাহারও কর্ণগোচর করাইতে পারিতাম না— লোকে ঢের কম শুনিত এবং ভুল শুনিত।”

 স্রোতস্বিনী দক্ষিণ পার্শ্বে ঈষৎ মুখ ফিরাইয়া একটা বহি খুলিয়া তাহার পাতা উলটাইতে উলটাইতে কহিল, “তুমি আমাকে স্নেহ করো বলিয়া আমাকে যতখানি দেখো আমি তো বাস্তবিক ততখানি নহি।”

 আমি কহিলাম, “আমার কি এত স্নেহ আছে যে, তুমি বাস্তবিক যতখানি আমি তোমাকে ততখানি দেখিতে পাইব। একটি মানুষের সমস্ত কে ইয়ত্তা করিতে পারে, ঈশ্বরের মতো কাহার স্নেহ।”

 ক্ষিতি তো এক্কেবারে অস্থির হইয়া উঠিল, কহিল, “এ আবার তুমি কী কথা তুলিলে। স্রোতস্বিনী তোমাকে এক ভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি আর-এক ভাবে তাহার উত্তর দিলে।”

 অমি কহিলাম, “আমি বলিতেছিলাম, যাহাকে আমরা ভালোবাসি কেবল তাহারই মধ্যে আমরা অনন্তের পরিচয় পাই। এমন কি, জীবের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করাই অন্য নাম ভালোবাসা। প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্যসম্ভোগ। সমস্ত বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে এই গভীর তত্ত্বটি নিহিত রহিয়াছে।

 “বৈষ্ণবধম পৃথিবীর সমস্ত প্রেম-সম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিতে চেষ্টা করিয়াছে। যখন দেখিয়াছে, মা আপনার সন্তানের মধ্যে আনন্দের আর অবধি পায় না, সমস্ত হৃদয়খানি মুহূর্তে মুহূর্তে ভাঁজে ভাঁজে খুলিয়া ঐ ক্ষুদ্র মানবাঙ্কুরটিকে সম্পূর্ণ বেষ্টন করিয়া