পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপযাত্রী
২৯১

নির্জন প্রকৃতির অনির্দিষ্ট অনির্বচনীয় বিষাদের সংগীত। কানাড়া টোড়ি প্রভৃতি বড়ো বড়ো রাগিণীর মধ্যে যে-গভীরতা এবং কাতরতা আছে সে যেন কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়, সে যেন অকূল অসীমের প্রান্তবর্তী এই সঙ্গীহীন বিশ্বজগতের।

 ২৩ অক্টোবর। সুয়েজ খালের মধ্যে দিয়ে জাহাজ অতি মন্থর গতিতে চলেছে।

 উজ্জ্বল উত্তপ্ত দিন। একরকম মধুর আলস্যে পূর্ণ হয়ে আছি। য়ুরোপের ভাব একেবারে দূর হয়ে গেছে। আমাদের সেই রৌদ্রতপ্ত শ্রান্ত দরিদ্র ভারতবর্ষ, আমাদের সেই ধরাপ্রান্তবর্তী পৃথিবীর অপরিচিত নিভৃত নদীকলধ্বনিত ছায়াসুপ্ত বাংলাদেশ, আমার সেই অকর্মণ্য গৃহপ্রিয় বাল্যকাল, কল্পনাক্লিষ্ট যৌবন, নিশ্চেষ্ট নিরুপম চিন্তাপ্রিয় জীবনের স্মৃতি, এই সূর্যকিরণে, এই তপ্ত বায়ুহিল্লোলে সুদুর মরীচিকার মতো আমার দৃষ্টির সম্মুখে জেগে উঠছে।

 ডেকের উপরে গল্পের বই পড়ছিলুম। মাঝে একবার উঠে দেখলুম, দুধারে ধূসরবর্ণ বালুকাতীর— জলের ধারে ধারে একটু-একটু বনঝাউ এবং অর্ধশুষ্ক তৃণ উঠেছে। আমাদের ডানদিকের বালুকারাশির মধ্যে দিয়ে একদল আরব শ্রেণীবদ্ধ উট বোঝাই করে নিয়ে চলেছে। প্রখর সূর্যালোক এবং ধূসর মরুভূমির মধ্যে তাদের নীল কাপড় এবং সাদা পাগড়ি দেখা যাচ্ছে। কেউ-বা এক জায়গায় বালুকাগহ্বরের ছায়ায় পা ছড়িয়ে অলসভাবে শুয়ে আছে, কেউ-বা নমাজ পড়ছে, কেউ-বা নাসারজ্জু ধরে অনিচ্ছুক উটকে টানাটানি করছে। সমস্তটা মিলে খররৌদ্র আরব-মরুভূমির একখণ্ড ছবি মতো মনে হল।

 ৩ নবেম্বর। অনেক রাত্রে জাহাজ বোম্বাই বন্দরে পৌঁছল।

 ৪ নবেম্বর। জাহাজ ত্যাগ করে ভারতবর্ষে নেমে এখন সংসারটা মোটের উপরে বেশ আনন্দের স্থান বোধ হচ্ছে। কেবল একটা গোল