পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছিন্নপত্র
৩০১

তাকে যে নম্রভাবে সম্মান করে যাচ্ছেন এতে কতটা মানিয়ে যাচ্ছে। সকলেই রাজা, সকলেই তার চেয়ে বয়সে বড়ো; ইন্দুমতী একটি বালিকা, সে-যে তাঁদের একে-একে অতিক্রম করে যাচ্ছে, এই অবশ্যরূঢ়তাটুকু যদি একটি-একটি সুন্দর সবিনয় প্রণাম দিয়ে না মুছে দিয়ে যেত তাহলে এই দৃশ্যের সৌন্দর্য থাকত না।

বর্ষার নদী

 শিলাইদা, ২১ জুলাই ১৮৯২। কাল বিকেলে শিলাইদহে পৌঁছেছিলুম, আজ সকালে আবার পাবনায় চলেছি। নদীর যে রোখ। যেন লেজ-দোলানো কেশর-ফোলানো তাজা বুনো ঘোড়ার মতো। গতিগর্বে ঢেউ তুলে ফুলে ফুলে চলেছে— এই খেপা নদীর উপর চড়ে আমরা দুলতে দুলতে চলেছি। ওর মধ্যে ভারি একটা উল্লাস আছে। এই ভরা নদীর যে কলরব সে কী আর বলব। ছল্‌ছল্ খল্‌খল্ করে কিছুতে যেন আর ক্ষান্ত হতে পারছে না, ভারি একটা যৌবনের মত্ততার ভাব। এ তবু গড়ই নদী, এখান থেকে আবার পদ্মায় গিয়ে পড়তে হবে; তার বোধ হয় আর কূল-কিনারা দেখবার জো নেই; সে মেয়ে বোধ হয় একেবারে উন্মাদ হয়ে খেপে নেচে বেরিয়ে চলেছে, সে আর কিছুর মধ্যেই থাকতে চায় না। তাকে মনে করলে আমার কালীর মূর্তি মনে হয়—নৃত্য করছে, ভাঙছে, এবং চুল এলিয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে। মাঝিরা বলছিল, নূতন বর্ষায় পদ্মার খুব ‘ধার’ হয়েছে। ‘ধার’ কথাটা ঠিক; তীব্রস্রোত যেন চক্‌চকে খড়্গের মতো— পাতলা ইস্পাতের মতো একেবারে কেটে চলে যায়, প্রাচীন ব্রিটনদের যুদ্ধরথের চাকায় যেমন কুঠার বাঁধা, দুইধারের তীর একেবারে অবহেলে ছারখার করে দিয়ে চলেছে।