পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিচূর্ণিত সত্তার মুখখামুখি হয়ে তারা আসলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গতকাল ধূসর, আগামীকাল ধূসরতর; তাই মরিয়া হয়ে অনিশ্চিত বর্তমানকে গোগ্রাসে গিলতে চাইছেন তারা। এতে যে বর্তমানই তাদের হাড়মাসমজ্জা গিলে খাচ্ছে—একথা বুঝবার মতো ধৈর্য ও অবকাশ নেই। ফলে সাহিত্যের অলংকৃত বাক আর প্রাকরণিক বিন্যাস তারা আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। লেখার মধ্য দিয়ে জীবনের পুনর্বাসন ঘটানোর ভরসায় থাকতে পারছেন না নিষ্ঠুর বর্তমানের ভয়ে। নিজেকে পাঠকৃতি ভেবে ক্রমাগত অনুশীলন করছেন—এখন এমন বৃত্তান্ত নিতান্ত দুর্লভ।

 আজ আমরা যখন লেখা নিয়ে ভাবি, অসীম রায়-কমলকুমার মজুমদার-দেবেশ রায়-সুবিমল মিশ্র-বাসুদেব দাশগুপ্ত-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-সৈকত রক্ষিত-নবারুণ ভট্টাচার্য-এর মতো আরও কয়েকটি নাম ছাড়া সমস্ত কিছুই অলংকৃত সাহিত্যের ছায়ায় নীল হতে দেখি। আরম্ভ আর পরিণতির মধ্যে এত বেশি ফারাক চোখে পড়ে যে বিচ্যুতিকেই নিয়ম বলে মনে হয়। অতিবিশাল কৃষ্ণবিবরের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখি একদা উচ্চারিত সংকল্প, জীবন-সংলগ্নতার প্রতিজ্ঞা আর ধারাবাহিকতার উপলব্ধিকে। প্রতিমূহূর্তে নতুন হয়ে-ওঠা লেখা কদাচিৎ চোখে পড়ে আজ। বরং গোলকধাঁধার সিঁড়িগুলি ঘুরতে ঘুরতে কোনো-এক অনির্দেশ্য অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে, এমন মনে হয়। ওইসব সিঁড়ির উপর শুনতে পাই অসংখ্য ধাবমান পদশব্দ। চিহ্নায়কশূন্য রিক্ততার গোল পিণ্ড গড়াতে গড়াতে সময়ের শীকারকে কেবল প্রবল থেকে প্রবলতর করে তুলছে। প্রতিমুহূর্তে নিজেকে অনুশীলন করার জন্যে কতখানি ভাঙতে রাজি হচ্ছি? সুখ আর দুঃখ, জয় আর পরাজয়, প্রতিষ্ঠা আর বিনাশ: এজাতীয় কিছু বিভাজন করে নিয়ে নিজেদের অনুভূতিকে পিঞ্জরায়িত করে তুলছি শুধু। ভান করছি। প্রতিবেদন রচনার। কবিতার বহিরঙ্গ ধরনকে মকসসা করে প্রতীক ও সংকেতের নামে নিরপেক্ষ, ধোঁয়াটে, বাচনশূন্য শব্দসজ্জার আড়ম্বর তৈরি করছি কখননা। আর কখনো কথকতার আভাসমাত্র সম্বল করে গল্পের, উপন্যাসের কাঠামো গড়ছি। এদের কোথাও আমি নেই তুমি নেই সেও নেই। কিন্তু জবরদস্ত সাহিত্য আছে। সেই সাহিত্যের চারপাশ নিয়ে আত্মমোহ আছে, প্রদর্শনী আছে, নগদ বিদায় নিয়ে ঈর্ষা-অসূয়া-আত্মপ্রচার আছে। এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্য জুড়ে চোরাবালির প্রসার, কেবলই সাহিত্যের ঢোলবাদ্য; কিন্তু লেখা নেই কোনোখানে: এই আশঙ্কা জাগে।

 নেই, কারণ জীবনের দ্বিরালাপ অস্বীকৃত। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যেন প্রশ্ন ফুরিয়ে গেছে। নানা অজুহাতে কেবলই মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া। সাহিত্যকর্ম এখন মাঝারিমাপের মানুষজনের, সাধারণভাবে যারা জীবমৃত, একচেটিয়া ভোগদখলের বস্তু। তাই গাণিতিক হিসাব-নিকাশ নিরঙ্কুশ। শিবির ভাঙা, শিবির গড়া, শিবির পুনর্বিন্যাস:একাজে প্রায় সবাই ব্যস্ত। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে তৎপর। স্বভাবত, এইসব লীলা সাম্প্রতিক সাহিত্যক্রিয়ার অপরিহার্য অংশ। লেখা নেই, অতএব

১০৬