পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ও বর্তমানের প্রতিবেদনকে তাই বারবার পুনর্গঠন করেছেন তিনি। অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘খেলার প্রতিভায় বিচূর্ণিত হয়েছে সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক আয়তন, দ্যুতিমান হয়ে উঠেছে লেখার আকাশ ও জমি।

 পণ্যসাহিত্যের উদ্ধত সন্ত্রাসকে যাঁরা হেলায় তুচ্ছ করেছেন, তাঁরাই বাচনিক সংস্কারের ঘেরাটোপ ভেঙে হয়ে উঠেছেন প্রতিস্রোতপন্থী। হয়তো তৃতীয় বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজনীতি তাদের বিনির্মাণে সর্বদা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। তবু প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের বিপরীত মেরু আবিষ্কার করার চেষ্টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, অমিয়ভূষণ মজুমদার, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, অসীম রায়, সুবিমল মিশ্র, রমানাথ রায়, সুবিমল বসাক, দেবেশ রায়, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সৈকত রক্ষিত, নবারুণ ভট্টাচার্য, রবিশংকর বল, কাজল শাহনেওয়াজ—এইসব নাম প্রমাণ করে যে সাহিত্যের কোলাহলমুখর হাটের একচেটিয়া আধিপত্য সত্ত্বেও এবং প্রতিস্রোতের মধ্যে নানা দুর্বলতা এবং স্ববিরোধিতা-কূটাভাস থাকলেও লেখা জীবন্ত আছে, জীবন্ত থাকবেও। এর কারণ,প্রতাপের দ্রুকুটি দিয়ে সাহিত্য নামক অচলায়তন যখন পরাজিত ও টুকরো মানুষের সমাবেশকে নিরঙ্কুশ করে তুলছে—সে-সময় লেখা বয়ে যাচ্ছে নতুন খাতে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভাত নেই পাথর রয়েছে’ সংকলনে ‘সময় হয়েছে’ কবিতাটি ওই নতুন খাতের সংকেতে ঋদ্ধ। কবি সেখানে লিখছেন:

‘সুন্দরের হাত পড়ে অগ্নি ও সমিধে
তার সবই চাই
সে হাত বাড়ায় চারিদিকে
লোপ অগ্নির মতো সে হাত বাড়ায় চারিদিকে
হাতে ও জিহ্বায় চায় বাগানের ফুল
গভীর, বিষন্ন, কালো-মানুষের ফুল
সমস্ত, সমস্ত, সব!’

 এই ব্যাখ্যাতীত বাচন (যেমন:‘সমস্ত, সমস্ত, সব’) অশ্মীভূত সাহিত্যে সম্ভব নয়, রক্তপ্রবাহে স্পন্দিত লেখায় সম্ভব। দৃষ্টান্ত আরও অনেক তুলে ধরা যায়। তবে শক্তির উদাহরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ; কারণ, আলো ও ছায়া, গতি ও স্থিতির দ্বন্দ্বে আকীর্ণতার কবিসত্তা। যখনই প্রাতিষ্ঠানিক রচনা-অভ্যাসে তিনি পিছলে পড়েছেন, পুনরাবৃত্তির চোরাবালি তাকে গ্রাস করেছে। কবিত্বের শশাচনীয় অবসাদ শক্তিকে আক্রমণ করেনি কেবল, তার সমসাময়িক ও পরবর্তী কবিদের ধারাবাহিকভাবে সংক্রামিত করেছে। প্রতিষ্ঠানের বিষবীজাণু সাফল্যের ডেলিরিয়ামে তাদের আচ্ছন্ন করেছে যত, ততই তারা লেখার সজীবতা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে উঠেছেন। ফলে অন্ধের দ্বারা নীয়মান অন্ধের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে কেবলই। কৃত্তিবাস-পরবর্তী কবিদের মধ্যে ভাস্কর চক্রবর্তী আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। যতক্ষণ দ্রষ্টা চক্ষুর অবিরল উন্মোচন, ততক্ষণই কবিতার শিল্পসংবিদ অক্ষুন্ন। যে-মুহূর্তে নিজস্ব বান্ধের মায়ায় নিজেই মুগ্ধ হতে শুরু

১১২