পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জেগে থাকতে হবে। এখানেই ভাবাদর্শ খুব প্রাসঙ্গিক, কারণ ভাবাদর্শ মানে যা আমাদের জাগিয়ে রাখে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত একটি গান ব্যবহার করে বলা যায়, হিমের রাতে গগনের দীপগুলিকে হেমন্তিকা যখন আড়াল করে—তখন তা ঘরে-ঘরে বার্তা পাঠায়: জ্বালাও আলো আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীকে! আধুনিকোত্তর পণ্য-সর্বস্ব জগতে সংস্কৃতিকর্মীকে লক্ষ করতে হয়, কীভাবে তার জগৎকে প্রতিজগৎ ও বাস্তবকে প্রতিবাস্তব করে ভোলা হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। বস্তুত একই সঙ্গে ইদানীং তাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে ভাবাদর্শহীনতা ও প্রতিভাবাদর্শের সঙ্গে। চূড়ান্ত ভোগবাদী অন্ধ সমাজ যখন প্রতিদিনই চোরাবালির পরিধি বাড়িয়ে চলেছে, উপগ্রহ-প্রযুক্তির বিশ্বায়ন হওয়ার ফলে দূরদর্শন ও কম্পিউটার ঘরে-ঘরে নিয়ে আসছে জ্ঞানশূন্য তথ্যের বুদ্বুদ ও রঙিন মিথ্যায় ভরা বিনোদন-সংস্কৃতি-কর্মীর যুদ্ধ এখন মঞ্চ থেকে সরে এসেছে প্রতিটি গৃহকোনে।

 এ সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়ানোর নয়। এ সময় নতুন করে যুদ্ধাস্ত্রে শান দেওয়ার। একথা মনে রেখে, যুদ্ধ কেবল বাইরে নয়, যুদ্ধ ভেতরেও। যুদ্ধ প্রকাশ্য নয় শুধু, যুদ্ধ গভীর গোপনেও। একবার যে সংস্কৃতির গাণ্ডীব তুলে নিয়েছে হাতে, অক্ষয় তৃণীরের সমর্থন সম্পর্কে এক মুহূর্তের জন্যেও ভরসা হারালে চলবে না তার। নিজেকে অনেক সময় আমরা নিজেরাই প্রতারিত করি, কুযুক্তিকে ভাবি যুক্তি, পিছিয়ে-পড়াকে ভাবি রণকৌশল। ভুলে যাই, একটি পথই খোলা সংস্কৃতি-কর্মীর: সে-পথ সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। থমকে দাঁড়ানো মানে পেছন-পায়ে হাঁটা, সে-পথ অন্ধকার কৃষ্ণবিবরে নিয়ে যায় শুধু। সমস্ত উদ্যম, সমস্ত অর্জন, সমস্ত উত্তাপ শুষে নিয়ে তা সংস্কৃতিকর্মীকে শেষ পর্যন্ত প্রতিভাবাদর্শের অন্ধকূপে বন্দী করে ফেলে। আধুনিকতাবাদী বিমানবায়নের বিরুদ্ধে যাঁর ঘোষিত যুদ্ধ ছিল, আধুনিকোত্তর নির্মানবায়ন পর্যায়ে তিনি কি যুদ্ধকে অস্বীকার করবেন? কল্পিত কিংবা বাস্তব কোনও অজুহাতে আত্মপ্রতারক যুক্তিশৃঙ্খলা সাজিয়ে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াবেন? তাহলে সেই পুরোনো প্রশ্নেই তো ফিরে যেতে হয় আবার: সংস্কৃতি তবে কী? সাধারণভাবে সংস্কৃতির এবং বিশেষভাবে গণনাট্যের ইতিহাস প্রমাণ করে: মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক কিংবা ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিকতার সেতু যখন কালো মেঘের ছায়ায় আবিল হয়ে ওঠে, সে-সময় সংস্কৃতিই নিয়ে আসতে পারে সূর্যোদয়ের অরুণাভাস। তাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দিনে কত গান কত নাটক সৃষ্টি হয়েছিল আজও যা আমাদের প্রেরণা দেয়। সংগ্রাম ও সৃষ্টির যুগলবন্দিতে প্রমাণিত ভাবাদর্শের অপরিহার্যতা। ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ও আগ্রাসী নয়া-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ আজ যদি তুঙ্গে ওঠে, সংস্কৃতি কখনও পিছিয়ে থাকতে পারে না কিংবা দ্বিধাগ্রস্তও হতে পারে না।

পুনরুজ্জীবিত সংস্কৃতিই ফিরিয়ে আনতে পারে মানব-সম্পর্কের স্বাভাবিকতা ও মানবিক বিকাশের ধারাবাহিকতা। রুটির লড়াই থেকে রুচির লড়াই যে আলাদা নয়,

১২০