পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 পুরো বয়ান উদ্ধৃত করলাম। আশা করি এটা সবাই অনুধাবন করবেন যে, সাধারণ নির্মিতির অনেক বাইরে এর অবস্থান। আসলে এটা নির্মিতিই নয়, প্রত্যক্ষ অনুভূতির রক্তক্ষরণ থেকে সরাসরি উঠে-আসা আত্মভাষা। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্বনির্ধারিত অভিভাবকেরা যাকে, এমন কী পশ্চাৎভূমি বলেও, চেনেন না—সেই বরাক উপত্যকার বাঙালিরা মাতৃভাষার জন্যে রক্ত ঝরানোর পরেও ‘বেশি-বাঙালিদের কাছে বাঙালি হিসেবেই গৃহীত হন না! ইংরেজি ভাষায় লণ্ডনের কনি বুলি কিংবা অস্ট্রেলীয় বাচন অথবা ইয়াংকি বুলি নিয়ে কিন্তু সংশয় হয় না কারও। চীনা বা স্পেনীয় ভাষাতেও অজস্র বৈচিত্র্য স্বীকৃত। তাহলে বাংলার উপভাষাগত সমৃদ্ধিকে কেন্দ্রীয় অবস্থানের অহংকারে কেন অবহেলা ও তাচ্ছিল্য করা হয়? এই একই ঔদ্ধত্য থেকে কলকাতায় প্রাতিষ্ঠানিক পণ্য-সাহিত্যের বৃত্তে রচিত সাহিত্যকে সপ্রতিভ প্রচার-কুশলতা দিয়ে একমাত্র মান্য সাহিত্যসৃষ্টির শিরোপা দেওয়া হয়।

 বাঁকুড়-পুরুলিয়ায় কিংবা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, ত্রিপুরায়, আসামের গৌহাটিতে ও বরাক উপত্যকায়, বিহারে এবং অবশ্যই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট পত্রিকার মধ্যে যাদের পাচ্ছি, তারা তাহলে কী? শুধু কী এই সান্ত্বনা পাওয়ার জন্যে লেখা-লেখা খেলায় মগ্ন তারা যে ‘they also serve who only stand and wait’! তাদের উদ্দেশে কলকাতা ও ঢাকার মহানাগরিক সাহিত্য-ব্যবসায়ীরা মাঝে-মাঝে প্রশংসার সিকি-আধুলি ছুঁড়ে দেবেন কিংবা পিঠ চাপড়ে দেবেন—এইজন্যে লেখেন মফঃস্বল’-এর কৃপাপ্রার্থী লেখকেরা? বরং তথাকথিত দূরপরিধির বাসিন্দা যারা, প্রতিষ্ঠান-পুষ্ট কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক প্রশ্রয়লোভী অভ্যাস-জর্জরিত ‘সাহিত্য’-এর চক্রব্যুহ থেকে বাইরে, তাদের ছোট পত্রিকার ওষধিমালা থেকে উৎসারিত লেখা’য় পাই জীবনের কথকতা। প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের নামে এঁরা মিথ্যার বেসাতি করেন না, কৃত্রিম চাকচিক্য দিয়ে চালাকি ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন না, ফাঁপা ইমারত গড়ে নিয়ে কেনাবেচার বাজার তৈরি করেন না, প্রতিজীবন ও প্রতিবাস্তবের বেপরোয়া নির্লজ্জ সমাবেশ তৈরি করেন না। বরং দূর ‘মফঃস্বল’-এর লেখায়, লোকায়ত পেশি ও লাবণ্য আর উপভাষার খর চলিষ্ণুতা ও সূক্ষ্ম কৌনিকতা নিয়ে, জীবনের যে-সব আশ্চর্য অনাবিষ্কৃত আয়তন উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে—সে-বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠুন নিবিষ্ট পড়ুয়ারা।

 একুশ শতকের সূচনাপর্বে বরং অপর পরিসরের লিখন-যোদ্ধারা একটি নতুন পর্যায় ও পদ্ধতির সূত্রপাত করুন। প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রিকতার বাইরে, কলকাতার উদ্ধত নাগরিক গ্রাম্যতার সংক্রমণ থেকে মুক্ত, যে-সব ছোট পত্রিকা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রচার-যন্ত্রের অভাবে একে অন্যের কাছে অপরিচিত—তারা সবাই নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে সমাবেশ করুক। সুচিন্তিত কর্মসূচির ভিত্তিতে পরস্পরের কাছাকাছি এসে সমস্ত সহযাত্রীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের ব্যবস্থা করুক। এই পারস্পরিক জানা-শোনা সংহত হয়ে উঠলে, রণকৌশলগত কারণে কলকাতায় মিলিত হোন লিখন-যোদ্ধারা। অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা-বিশ্বাস-ভাবাদর্শ এইসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাঁদেরই সুপরীক্ষিত

৬২