পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আসামকে ক্রমাগত টুকরো করেছেন, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে আগুন জ্বালিয়েছেন। তবু এরা পণ করেছেন, অসমিয়াকরণ আর খিড়কি-দুয়ার দিয়ে নয়, সদর দরজা দিয়ে করবেন। এদের শিক্ষা হবে কি? এদের জন্যে সময়ের কোনও ভাষা নেই, নতুন পাঠ নেই কোনও।

 আসলে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হওয়ায় এবং উনিশে মে নতুন মর্যাদায় পালিত হওয়ার সম্ভাবনায় অন্ধকারের হায়েনা শেয়ালেরা গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। তার ওপর, চিরঘুমন্ত বাঙালি নবজাগরণ-এর উদাত্ত আহ্বানে পশ্চিমবঙ্গে নিদালির ঘোর কাটিয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বাংলা ভাষা কেবল হিন্দুর নয়, কেবল মুসলমানের নয়। হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালির মিথ্যা পরিচয়ের গোলকধাঁধার বিরুদ্ধে একুশ শতকের উদয়-মুহূর্তে নতুন চেতনার বিচ্ছুরণ শুরু হয়েছে—এই সত্য অনুভব করে টনক নড়েছে বিবরবাসীদের। ভাড়াটে কলমচিরা তক্কেতক্কে ছিল, নবজাগরণের তাৎপর্য নিয়ে উপভাষা অঞ্চলের প্রান্তিক বাঙালিরা ঠিক কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে, এ নিয়ে তাদের একটি শব্দও খরচ করতে দেখিনি। কিন্তু ঘেঁকশেয়ালেরা রাজকীয় জোব্বা পরে নেওয়ার জন্যে হুক্কা-হুয়া শুরু করা মাত্র ওই কলমচিরা একটুও দেরি না করে বারো হাত কাকুরের তেরো হাত বীচি নিয়ে বিজ্ঞজনোচিত ভাষ্য লিখতে শুরু করেছে। যে-বিষয় ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত, তা মনোযোগের অযোগ্য, তড়িঘড়ি তার টীকা-ভাষ্য করার অর্থ কি ঘোলাজলে মাছ শিকারের জন্যে কাউকে কাউকে উসকে দেওয়া? এতে নিজেদের অবস্থান হাস্যকর হয়ে গেলেও কিংবা নিজেদের মুখ পুড়ে গেলেও কিছু যায় আসে —এই কি মনোগত অভিপ্রায়?

 তাহলে পঁচিশে বৈশাখের সকালেই ভাষিক সম্প্রসারণবাদী ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদীরা শিলচরে গান্ধীবাগের চত্বর দখল করতে থাকুক। আমাদের বুকে বসে আমাদেরই দাড়ি উপড়াতে থাকুক উদ্ধত প্রতাপে, আগ্রাসনবাদীরা আমাদের শিলনোড়া দিয়ে আমদেরই দাঁতের গোড়া ভাঙতে থাকুক। শিলচর সহ বরাক উপত্যকার সমস্ত জনপদে দিনরাত বাজতে থাকুক চটুল বিহুগীতি ও জৈব প্রবৃত্তিতে সুড়সুড়ি-দেওয়া হিন্দি ভাষার কোলাহল। পিঠ পুড়ে পুড়ে অস্থিমজ্জায় আগুন ধরে গেলেও ফিরে শোয়ার কথকতা চালিয়ে যাই আমরা। উনিশে মে ফিরে যাক ব্যর্থ নমস্কারে। আমরা তো সিলেটিতে কথা বলি, শিষ্ট বাংলায় বলি না। বাংলার আর কোনও উপভাষা অঞ্চলে অন্তত এটা দেখব না, বৃহত্তর সামাজিক পরিমণ্ডলে শিষ্ট চলিত ব্যবহার করলে আড়াল থেকে কেউ বিদ্রুপ করছে।‘দেশি কুকুর বিলিতি কুকুরের বুলি আওড়াচ্ছে বলে মূখতম উপহাসে একে অপরের শরিক হচ্ছে। পুরুলিয়া বীরভূম-কোচবিহারবাঁকুড়া-বগুড়া- চট্টগ্রামে কখনও এই অভিজ্ঞতা হবে না যে, আনুষ্ঠানিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমাবেশে কেউ প্রকাশ্যে নিজের উপভাষায় ভাষণ দিচ্ছে। উপভাষার নিজস্ব কিছু বাগবিধি, স্বরন্যাস কিংবা উচ্চারণভঙ্গি থাকতে পারে—এইমাত্র। অন্যত্র এটা কল্পনারও অগোচর যে, নিজেরই ভাষার শিষ্টরূপে সড়গড় হওয়ার জন্যে কেউ

৮৮