পাতা:সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
২৬২
সাহিত্য

নাসাগ্রস্থিত একশৃঙ্গের মতো ভীষণভাবে উদ্যত রাখাকেই ধর্ম বলিয়া গণ্য করিয়াছে; তাই সেখানে সাহিত্যরঙ্গভূমিতে ‘একে একে নিবিছে দেউটি’ এবং আজ প্রায় ‘নীরব রবাব বীণা মুরজ মুরলী’।

 ইহা হইতে বুঝিতে হইবে, যে-সকল ভাব বিশ্বমানবের অভিমুখীন তাহাই সাহিত্যকে জীবনদান করে। বৈষ্ণবধর্মপ্লাবনের সময় বিশ্বপ্রেম যেদিন বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে সমস্ত কৃত্রিম সংকীর্ণতার বেড়া ভাঙিয়া দিয়া উচ্চনীচ শুচি-অশুচি সকলকেই এক ভগবানের আনন্দলোকে আহ্বান করিল সেইদিনকার বাংলাদেশের গান বিশ্বের গান হইয়া জগতের নিত্যসাহিত্যে স্থান পাইয়াছে। কিন্তু শুষ্কধর্ম যখন সর্বমানবের মহেশ্বরকে দূরে রাখিয়া মানুষের মধ্যে কেবল বাছ-বিচার এবং ভেদ-বিভেদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সীমাবিভাগ করিতে ব্যগ্র হয় তখন সাহিত্যের রসপ্লাবন শুষ্ক হইয়া যায়, কেবল তর্কবিতর্ক-বাদবিবাদের ধুলা উড়িয়া আকাশ আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে।

 বৈষ্ণবকাব্যই আমাদের দেশের সাহিত্যকে প্রথম রাজসভার সংকীর্ণ আশ্রয় হইতে বৃহৎভাবে জনসমাজের মধ্যে বাহির করিয়া আনিল। পর্বতের গুহা ভেদ করিয়া ঝর্না বাহির হইল। কিন্তু নানা দিক হইতে নানা ধারা আসিয়া না জুটিলে নদী হয় না। আজ বাংলায় গদ্যে-পদ্যে-সম্মিলিত সাহিত্য বাঙালি-জনসাধারণের হৃদয় হইতে বিচিত্র ভাবস্রোত বিবিধ জ্ঞানপ্রবাহ অহরহ আকর্ষণ করিয়া পরিপুষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। এই সাহিত্যেই বাংলায় উত্তরদক্ষিণ পূর্বপশ্চিম সমস্ত প্রদেশ নিরন্তর আপনাকে মিলিত করিতেছে। নিখিল বাঙালির এই হৃদয়সংগমস্থলই বাঙালির সর্বপ্রধান মিলনতীর্থ। এই তীর্থেই আমাদের জাগ্রত দেবতার নিত্য অধিষ্ঠান হইবে এবং এইখানেই আমরা আমাদের সমস্ত যত্ন প্রীতি ও নৈপুণ্যের দ্বারা এমন ধর্মশালা নির্মাণ করিব যেখানে চিরদিন আমদের উত্তরকালীন যাত্রিগণ আশ্রয় লাভ করিতে পারিবে।

 সাহিত্যের নামে আমরা আজ এই-যে মিলনের সভা আহ্বান করিয়াছি