বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬৮
সীতারাম

 গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া শ্রী দেখিলেন, গৃহ বড় নিভৃত, তাহার এক ঘরে এক কালী মুর্ত্তি, ফুল বিল্বপত্রে অর্দ্ধেক ঢাকা পড়িয়া আছেন। গৃহে কেহ নাই, কেবল এক অশীতিপর বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী। তিনিই দেবীর অধিকারিণী। চন্দ্রচূড়কে দেখিয়া বৃদ্ধা বলিল, “তর্ক বাবা যে গো?”

 চন্দ্র। কেমন মা? মার পূজা চলিতেছে কেমন?

 অশীতিপর বৃদ্ধার শ্রবণেন্দ্রিয় বড় তীক্ষ্ণ নহে। সে শুনিল, “তোমার বোন্পো‌ আছে কেমন?” উত্তরে বলিল, “আজও জ্বর সারে নাই, তার উপর পেটের ব্যামো, মা কালী রক্ষা করিলে হয়।” চন্দ্রচূড় এইরূপ দুই চারিটা কথাবার্ত্তা বৃদ্ধার সঙ্গে কহিবাতে শ্রী বুঝিল—বুড়ী ঘোর কালা। চন্দ্রচূড় তখন শ্রীকে বলিলেন, “এই বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর ঘরে তুমি আজ কাল থাক। তার পর গঙ্গারাম সুস্থির হইলে, আমি তোমাকে তাহার কাছে লইয়া যাইব। তোমার নিজ বাড়ীতে এখন একা থাকিবে কি প্রকারে? বিশেষ মুসলমানের ভয়।”

 শ্রী। ঠাকুর! মুসলমানের এ দৌরাত্ম্য কত কাল আর থাকিবে? শাস্ত্রে কি কিছু নাই?

 চন্দ্র। কিছু না, মা। এ শাস্ত্রের কথা নয় মা। হিন্দুর গায়ে বল হইলেই হইল।

 শ্রী। ঠাকুর! হিন্দুর গায়ে বলের কি অভাব? এই ত এখনই দেখিলেন?

 বলিতে বলিতে শ্রী, দৃপ্তা সিংহীর মত ফুলিয়া উঠিল।

 চন্দ্র। যা দেখিলাম মা, সে তোমারই বল—এমন কি আবার হইবে?

 দৃপ্তা সিংহী লজ্জায় মুখ অবনত করিল। আবার মুখ তুলিয়া বলিল, “হিন্দুর গায়ে বলের এত অভাব কেন? কত লোকের বলের গল্প শুনি।”

 তীক্ষ্ণবুদ্ধি চন্দ্রচূড় শ্রীর অলক্ষ্যে, শ্রীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন, মনে মনে বলিলেন, “বেশ বাছা, বেশ! আমার মনের মত মেয়ে তুমি। আমিও সেই কথাটা ভাবিতেছিলাম।” প্রকাশ্যে বলিলেন, “হিন্দুর মধ্যে বলবান্ কি নাই? আছে বৈ কি। কিন্তু তাহারা মুসলমানের মুখ চায়। এই দেখ সীতারাম—সীতারাম না পারে কি? কিন্তু সীতারাম রাজভক্ত—বাদশাহের অনুগৃহীত—অকারণে রাজদ্রোহী হইবে না। কাজেই কে ধর্ম্ম রক্ষা করে?”

 শ্রী। কারণ কি নাই?

 জিজ্ঞাসা করিয়া শ্রী আবার লজ্জায় মুখ নামাইল। বলিল, “আমি অবলা —আপনাকে কেন এত জিজ্ঞাসা করিতেছি, জানি না,— আমার মার শোকে ভাইয়ের দুঃখে মন কেমন হইয়া গিয়াছে—তাই আমার জ্ঞান বুদ্ধি নাই।”

 চন্দ্রচূড় সে কৈফিয়ৎটা কানেও না তুলিয়া, বলিলেন, “কারণ ত ঘটে নাই। ঘটিলে কি হইবে বলিতে পারি না। সীতারাম যত দিন মুসলমানের দ্বারা অত্যাচার প্রাপ্ত না হয়েন, বোধ হয় তত দিন তিনি রাজদ্রোহ-পাপে সম্মত হইবেন না।”

 শ্রী অনেকক্ষণ নীরবে ভাবিতে লাগিল। চাতক পক্ষী যেমন মেঘের প্রতি চাহিয়া থাকে, ততক্ষণ চন্দ্রচূড় তাহার মুখ প্রতি সেইরূপ করিয়া চাহিয়া রহিলেন। শ্রী বহুক্ষণ অন্যমনা হইয়া ভাবিতেছে,