পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গাছের কচি মাল পিটিয়া থ্যাৎলাইয়া কাগজের মতো একরকম জিনিস তৈয়ার করত। এই 'পেপিরাস’ কথা হইতেই ইংরাজি পেপার (Paper) শব্দটা আসিয়াছে। কিন্তু এই পেপিরাস জিনিসটাকেও ঠিক কাগজ বলা যায় না। কাগজ তৈয়ারির উপায় প্রথম বাহির হইয়াছিল চীনদেশে। কিন্তু চীনারা এই বিদ্যা আর কাহাকেও শিখাইত না। প্রায় বারোশত বৎসর হইল কতকগুলি চীনা কারিকর আরবীদের সঙ্গে যুদ্ধে ধরা পড়ে। তাহাদের কাছে অরবের কারিকরেরা কাগজ বানাইতে শিখিয়া লইল, এবং সেইসময় হইতেই এই বিদ্যা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। আরব হইতে ইজিপ্ট, ইজিপ্ট হইতে আফ্রিকার অন্যান্য জায়গায় হয়।

 তার পর স্পেন, জার্মানি, ইংলণ্ডে সকল জায়গায়ই ক্রমে ক্রমে কাগজের কারখানা দেখা দিল। সে সময়ে ছেড়া নেকড়া দিয়া সমস্ত কাগজ তৈয়ারি হইত এবং সেটা আগাগোড়াই হাতে হইত। পরিষ্কার নেকড়াকে ভিজাইয়া একটা দাঁতাল জিনিস দিয়া ঠেঙানো হইত। তাহাতে নেকড়াটা ছিড়িয়া সূতার আঁশের মতো টুকরা টুকরা হইয়া যাইত। তাহাতে জল মিশাইয়া আরো অনেকক্ষণ পিটিলে কতকটা পাতলা মণ্ডের মতো একটা জিনিস হয়। এই নেকড়ার মণ্ডকে চালনিতে চালিয়া নানারকমে ছাঁকিয়া ঝাঁকাইয়া, লুচির মতো বেলিয়া তবে কাগজ তৈয়ারি হইত। সে সময়ে লোক কাগজটাকে খুব একটা শৌখিন জিনিস বলিয়াই মনে করিত, কিন্তু ক্রমে কাগজের দাম কমিয়া আসিল, কাগজ বানাইবার নানারকম কল বাহির হইল আর কাগজের কাটতি এত বাড়িয়া গেল যে কাগজওয়ালারা দেখিল এত ছেড়া নেকড়াই জোগাড় করা সম্ভব নয়। তখন চারিদিক খোঁজ পড়িয়া গেল, আর কি জিনিস হইতে কাগজ করা যাইতে পারে। প্রথমত স্পেনদেশের এস্পার্টো ঘাসে খুব কাগজ হইত, তার পর ক্রমে দেখা গেল তাহাতেও কুলায় না। সেই হইতে কাগজ বানাইবার জন্য কত জিনিস লইয়া যে পরীক্ষা হইয়াছে তাহা বলা যায় না। আখের ছিব্‌ড়া, কলার খোসা, পাট, খড়, ঘাস, বাঁশ, কাঠ-সূতার মতো আঁশওয়ালা, আখের মতো ছিবড়ওয়ালা যতরকম জিনিস আছে তার কোনোটিই বাকি নাই। মোটের উপর বলা যাইতে পারে কাঠ, এস্পার্টো ঘাস আর পুরাতন নেকড়া ও কাগজ হইতেই আজকাল কাগজ প্রস্তুত হয়।

 বোলতা যে চাক বানায় তাহার মধ্যে একটা জিনিস থাকে সেটা ঠিক কাগজের মতো। বোলতারা গাছের শাস খায় এবং সেই শাসকে চিবাইয়া হজম করিয়া এই কাগজ বাহির করে। আজকাল কাগজের কলেও সেইরূপে কাঠ ঘাস প্রভৃতি জিনিস হইতে নানারকম কাগজ তৈরি হয়। অবশ্য কাগজওয়ালাদের ঐসব জিনিস বোলতার মতো চিবাইতে হয় না। এ-সব কাজই কলে হয়।

 যে কাঠ হইতে কাগজ প্রস্তুত হয় সেই কাঠ আসে আমেরিকা ও নরওয়ের জঙ্গল হইতে। জঙ্গলওয়ালারা বড়ো-বড়ো গাছের গুঁড়ি কাটিয়া কলের মুখে ফেলিয়া দেয়—আর কলের আর-এক মাথায় কাঠ কুচি হইয়া বাহির হয়। সেই কুচিকে গুঁড়াইয়া, সিদ্ধ করিয়া পরিষ্কার করিতে হয়, তার পর সেই ক্ষীরের মতো নরম কাঠকে চাপ দিয়া পাতলা পাতলা পাটালি বানানো হয় এবং সেই পাটালি কাগজওয়ালাদের কাছে চালান দেওয়া হয়।

নানা নিবন্ধ
১৫১