পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 মনে কর অমরা এইরূপ একটা জাহাজের মধ্যে ঢুকিয়াছি—ঢুকিয়াই সকলের আগে চোখে পড়ে—জাহাজের এক মাথা হইতে আর এক মাথা পর্যন্ত কেবল চাকা আর লোহা কলকব্‌জা। চেয়ার টেবিল আসবাবপত্র নাই বলিলেই হয়। সমস্ত জাহাজটা যেন একটা প্রকাণ্ড বৈদ্যুতিক কারখানা। সেই বিদ্যুতে জাহাজ চলে এবং জাহাজের বাতি জ্বালা রান্না করা পর্যন্ত সমস্ত কাজ হয়। জাহাজের কাপ্তান কোথায়? ঐ যে তিনি জাহাজের টুপির নীচে বসিয়া দিকবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া চারিদিক দেখিতেছেন।

 কাপ্তান উপর হইতে হুকুম করিতেছেন আর অন্য একটি কর্মচারী নাবিকদিগের দ্বারা সেই হুকুম তামিল করাইতেছেন। প্রত্যেক লোক তাহার নিজের নিজের জায়গায় প্রস্তুত হইয়া আছে-কখন কি হুকুম আসে। কাপ্তান বলিলেন ‘জাহাজ ডাইনে ফিরাও', অমনি একটা চাকা ঘুরাইবামাত্র জাহাজ ডাইনে ফিরিয়া গেল। 'থাম! টর্পিডোওয়ালা, প্রস্তুত হও।' টর্পিডো কেন? শত্রপক্ষের জাহাজ দেখা গিয়াছে। টর্পিডো বড়ো সাংঘাতিক অস্ত্র। একবার বিপক্ষের জাহাজে ভালোমতো টপিডো দাগিতে পারিলে আর দ্বিতীয়বার মারিবার দরকার হয় না। একটা প্রকাণ্ড ছুঁচোবাজির মতো তার চেহারা-তার ভিতরে বারুদ আর অদ্ভুত কল-কারখানা। ডুবুরী জাহাজের সামনেই টপিডোর কলখানা—সেই কলের চাবি টিপিলেই টর্পিডো ঘণ্টায় চারশো মাইল বেগে ছুটিয়া বাহির হয় এবং বিপক্ষের জাহাজে বা অন্য কোনো শক্ত জিনিসে ঠেকিয়া বাধা পাইবামাত্র ভয়ানক শব্দে ফাটিয়া ও জাহাজ ফাটাইয়া এক তুমুল কাও বাধাইয়া দেয়। বড়ো ডুবুরী জাহাজে তিন-চারটি পর্যন্ত টর্পিডো কল থাকে। 'টপিডোওয়ালা, প্রস্তুত হও!' হুকুম অসিবামাত্র তাহারা প্রস্তুত। সকলেই জানিয়াছে বিপক্ষের জাহাজ আসিতেছে-কাহারও মুখে টুঁ শব্দটি নাই। জাহাজের মধ্যে কেবল কলের বন্‌বন্ শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নাই।

 হুকুম আসিল 'চল্লিশ হাত নামাও’-বলিতে বলিতে জাহাজ ডুবিতে লাগিল। একটা কলের কাঁটা আস্তে আস্তে সরিয়া যাইতে লাগিল -কুড়ি হাত, পঁচিশ হাত, ত্রিশ হাত। চল্লিশ-এর দাগে কাঁটা নামিল। এখন আর বাহিরের কিছুই দেখা যায় না। কাপ্তান এখন ঘড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকাইয়া আছেন। বিপক্ষের জাহাজটি ঠিক কোনদিকে এবং কত দূরে তিনি খুব ভালো করিয়া তাহার হিসাব লইয়াছেন—তাঁহার জাহাজ কিরকম জোরে চলিতেছে তাহাও তিনি জানেন–সুতরাং তিনি ঠিক বলিতে পারেন কোন মুহর্তে দুই জাহাজে কতখানি তফাত থাকিবে। নিঃশব্দে জলের নীচে জাহাজ চলিতেছে শত্রু জাহাজ কিন্তু তাহার কিছুই জানে না। 'জাহাজ উঠিতে দাও’-আবার কলের কাঁটা নড়িয়া উঠিল—“ত্রিশ হাত, বিশ হাত, দশ হাত–বাস।'—‘সম্মুখের টর্পিডো হঁশিয়ার হও। এতক্ষণে দিকবীক্ষণ যন্ত্র ভাসিয়া উঠিয়াছে-আবার সব দেখা যাইতেছে। আধ মাইল দূরে শত্রুর জাহাজ-প্রকাণ্ড যুদ্ধজাহাজ। প্রায় কুড়িটা ডুবুরীর সমান। কাপ্তান একমনেই হিসাব করিতেছেন জাহাজটা আরেকটু সামনে সরুক, আরেকটু, আরেকটু—বাস। 'ছাড়'! একটা ভয়ানক ধাক্কা লাগিল—ডুবুরী জাহাজ কাঁপিতে কাঁপিতে প্রায় কাত হইয়া গেল-হালের নাবিক তাড়াতাড়ি তাহাকে সামলাইয়া লইল। কিন্তু বিপক্ষের জাহাজে যে টর্পিডো লাগিল সে আর তাহা সামলাইতে পারিল না। জাহাজের গায়ে বিশ হাত গর্ত-জাহাজটা

১৫৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২