পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/১০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হিসাবটা হল বলে।” তখন বেগতিক দেখিয়া বর বলিল, “আরে, ব্যাপারটা কিছু নয়—আজ রাত্রে আমার এক জায়গায় নিমন্ত্রণ আছে—তাই, বড় তাড়াতাড়ি।”

 এই কথা শুনিবামাত্র নাপিত একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। সে বলিল, “ভাগ্যিস্‌ মনে করিয়ে দিলেন! আমার বাড়িতেও যে আজ ছয়জন লোককে নেমন্তন্ন করে এসেছি! তাদের জন্য তো’ কোনরকম বন্দোবস্ত করে আসি নি। এখন, মনে করুন, মাংস কিনতে হবে, রাঁধবার ব্যবস্থা করতে হবে, মিঠাই আনতে হবে; কখন-বা এসব করি, আর কখনই-বা আপনাকে কামাই।” বর দেখিল আবার বেগতিক, সে নিরুপায় হইয়া বলিল, “দোহাই তোমার। আর আমায় ঘাঁটিও না—আমার চাকরকে বলে দিচ্ছি—তোমার যা কিছু চাই, আমার ভাঁড়ার থেকে সমস্তই সে বা’র করে দেবে—তার জন্য তুমি মিথ্যে ভেব না।” নাপিত বলিল, “এ অতি চমৎকার কথা। দেখুন, হামামের মালিশওয়ালা জান্তৌৎ—আর ঐ যে কড়াইশুঁটি বিক্রি করে, সালি—আর ঐ শিম বেচে, সালৌৎ—আর আখের শা তরকারিওয়ালা আর আবু মেকারেজ ভিস্তি আর পাহারাদার কাশেম—এরা সবাই ঠিক আমার মতো আমুদে—এরা কখনো মুখ হাঁড়ি করে থাকে না; তাই এদের আমি নেমন্তন্ন করেছি। আর এদের একটা বিশেষ গুণ যে, এরা ঠিক আমারই মত চুপচাপ থাকে—বেশি বকবক করতে ভালোবাসে না। এক-একজন লোক থাকে তারা সব সময়েই বকর বকর করছে—আমি তাদের দুচক্ষে দেখতে পারি নে। এরা কেউ সেরকম নয়; তবে নাচতে আর গাইতে এরা সবাই ওস্তাদ। জান্তৌৎ কি রকম করে নাচে দেখবেন? ঠিক এইরকম”— এই বলিয়া সে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নৃত্য ও বিকট সুরে গান করিতে লাগিল। কেবল তাহাই নয়, ঐ ছয়জন বন্ধুর মধ্যে প্রত্যেকে কিরকম করিয়া নাচে ও গায়, তাহার নকল দেখাইয়া তবে সে ছাড়িল। তারপর, হঠাৎ সে ক্ষুরটুর ফেলিয়া ভাঁড়ার ঘরে চাকরের কাছে তাহার নিমন্ত্রণের ফর্দ দিতে ছুটিল। বর ততক্ষণে আধ কামান অবস্থায় ক্ষেপিয়া পাগলের মত হইয়াছে, কিন্তু নাপিত তাহার কথায় কানও দেয় না। সে গম্ভীরভাবে ঘরের হাঁস মুরগি তরি-তরকারি হালুয়া মিঠাই সব বাছিয়া বাছিয়া পছন্দ করিতে লাগিল। তারপর আরো অনেক গল্প আর অনেক উপদেশ শুনাইয়া অতি ধীর মেজাজে সাড়ে চার ঘণ্টায় সে তাহার কামানো শেষ করিল। আবার যাইবার সময় বলিয়া গেল, “দেখুন, আমার মতো এমন বিজ্ঞ, এমন শান্ত, এমন অল্পভাষী হিতৈষী বন্ধু আপনি পেয়েছেন, সেটা কেবল আপনার বাবার পুণ্যে। আজ হতে আমি আপনার কেনা হয়ে রইলুম।”

 নাপিতের হাত হইতে উদ্ধার পাইয়া বর দেখিল, আর সময় নাই। সে তাড়াতাড়ি বিবাহ করিতে বাহির হইল। লোকজন সঙ্গে লইল না, এবং কাহাকেও খবর দিল না; পাছে কথাটা কোন গতিকে কাজিসাহেবের কাছে ফাঁস হইয়া যায়।

 এদিকে নাপিতও কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকে নাই। সে কেবল ভাবিতেছে, “না-জানি সে কি রকম নেমন্তন্ন, যার জন্য সে এমন ব্যস্ত, যে আমার ভালো ভালো কথাগুলো পর্যন্ত শুনতে চায় না। ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে।” সুতরাং বর যখন সন্ধ্যার সময় বাহির হইল, নাপিতও তাহার পিছন পিছন লুকাইয়া চলিল।

 বর সাবধানে কাজির বাড়ি হাজির হইয়া খবর লইল যে কাজিসাহেব বাড়িতে নাই; এদিকে সব আয়োজন প্রস্তুত—তাড়াতাড়ি বিবাহ সারিতে হইবে। দৈবাৎ যদি কাজিসাহেব আসিয়া পড়েন, তাহার জন্য ছাতের উপর পাহারা বসান হইল, তাঁহাকে

দেশ-বিদেশের গল্প
১০১