পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চিৎকার করে সভার মাঝখানে পড়ে গেল। রাজা মন্ত্রী পাত্র-মিত্র উজির-নাজির সবাই ব্যস্ত হয়ে বললেন, “কি হলো, কি হলো?” তখন অনেক জলের ছিটে পাখার বাতাস আর বলা কওয়ার পর লোকটা কাঁপতে কাঁপতে উঠে বলল, “মহারাজ সেটা কি দাঁড়কাক ছিল?” সকলে বলল, “হাঁ-হাঁ-হাঁ, কেন বল দেখি?” লোকটা আবার বলল, “মহারাজ, সে কি ঐ মাথার উপর দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসেছিল—আর মাথা নিচু করেছিল, আর চোখ পাকিয়েছিল, আর ‘কঃ’ করে শব্দ করেছিল?” সকলে ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে বললে, “হাঁ, হাঁ—ঠিক ঐরকম হয়েছিল।” তাই শুনে লোকটা আবার ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল—আর বলতে লাগল, “হায়, হায়, সেই সময়ে কেউ আমায় খবর দিলে না কেন?”

 রাজা বললেন, “তাই তো, একে তোমরা তখন খবর দাও নি কেন?” লোকটাকে কেউই চেনে না তবু সে কথা বলতে সাহস পেল না, সবাই বললে, “হ্যাঁ, ওকে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল”—যদিও কেন তাকে খবর দেবে, আর কি খবর দেবে, এ কথা কেউ বুঝতে পারল না। লোকটা তখন খুব খানিকটা কেঁদে তারপর মুখ বিকৃত করে বলল, “দ্রিঘাংচু!” সে আবার কি! সবাই ভাবল, লোকটা খেপে গেছে।

 মন্ত্রী বললেন, “দ্রিঘাঞ্চু কি হে?” লোকটা বলল, “দ্রিঘাঞ্চু নয়, দ্রিঘাংচু।” কেউ কিছু বুঝতে পারল না—তবু সবাই মাথা নেড়ে বলল, “ও!” তখন রাজামশাই জিজ্ঞাসা করলেন, “সে কিরকম হে,” লোকটা বলল, “আজ্ঞে আমি মূর্খ মানুষ, আমি কি অত খবর রাখি, ছেলেবেলা থেকে দ্রিঘাংচু শুনে আসছি, তাই জানি দ্রিঘাংচু যখন রাজার সামনে আসে, তখন তাকে দেখতে দেখায় দাঁড়কাকের মতো। সে যখন সভায় ঢোকে, তখন সিংহাসনের ডান দিকের থামের উপর বসে মাথা নিচু করে দক্ষিণ দিকে মুখ করে, চোখ পাকিয়ে ‘কঃ’ বলে শব্দ করে। আমি তো আর কিছ জানি না—তবে পণ্ডিতেরা যদি জানেন।” পণ্ডিতেরা তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে বললেন, “না, না, ওর সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায় নি।”

 রাজা বললেন, “তোমায় খবর দেয় নি ব’লে কাঁদছিলে, তুমি থাকলে করতে কি?” লোকটা বলল, “মহারাজ, সে কথা বললে যদি লোকে বিশ্বাস না করে, তাই বলতে সাহস হয় না।”

 রাজা বললেন, “যে বিশ্বাস করবে না, তার মাথা কাটা যাবে—তুমি নির্ভয়ে বলে ফেল।” সভাসুদ্ধ লোক তাতে হাঁ হাঁ ক’রে সায় দিয়ে উঠল।

 লোকটা তখন বলল, “মহারাজ, আমি একটা মন্ত্র জানি, আমি যুগজন্ম ধরে বসে আছি, দ্রিঘাংচুর দেখা পেলে সেই মন্ত্র তাকে যদি বলতে পারতাম তা হলে কি যে আশ্চর্য কাণ্ড হত তা কেউ জানে না। কারণ, তার কথা কোন বইয়ে লেখে নি। হায় রে হায়, এমন সুযোগ আর কি পাব?” রাজা বললেন, “মন্ত্রটা আমায় বল তো।” লোকটা বলল, “সর্বনাশ! সে মন্ত্র দ্রিঘাংচুর সামনে ছাড়া কারুর কাছে উচ্চারণ করতে নেই। আমি একটা কাগজে লিখে দিচ্ছি—আপনি দুদিন উপোস ক’রে তিন দিনের দিন সকালে উঠে সেটা পড়ে দেখবেন। আপনার সামনে দাঁড়কাক দেখলে, তাকে আপনি মন্ত্র শোনাতে পারেন, কিন্তু খবরদার, আর কেউ যেন তা না শোনে—কারণ, দাঁড়কাক যদি দ্রিঘাংচু না হয়, আর তাকে মন্ত্র বলতে গিয়ে অন্য লোকে শুনে ফেলে, তা হলেই সর্বনাশ!”

 তখন সভা ভঙ্গ হল। সভার সকলে এতক্ষণ হাঁ ক’রে শনছিল, তারা হাঁফ

১২০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী