পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 দূত বলল, “দেবতার কৃপায় কত কোটি টাকা রাজভাণ্ডারে মজত রয়েছে, যেন টাকার সমুদ্র। তার থেকে এক-আধ ঘটি তুললেই-বা মহারাজের ক্ষতি কি?”

 রাজা বললেন, “দেদার থাকলেই কি দেদার খরচ করতে হবে?”

 দূত বলল, “প্রতিদিন আতরে, সুগন্ধে, পোশাকে, আমোদে, আর প্রাসাদের সাজ-সজ্জায়ে টাকা বেরিয়ে যায়, তারই খানিকটা পেলে লোকগুলো প্রাণে বাঁচে।”

 শুনে রাজা রেগে বললেন, “ভিখারি হয়ে আবার উপদেশ শোনাতে এসেছ? আমার টাকা আমি সিদ্ধ করেই খাই আর ভাজা করেই খাই, সে আমার খুশি! তুমি বাপু আর বেশি জ্যাঠামি করলে শেষে বিপদ ঘটতে পারে। সুতরাং এই বেলা মানে মানে সরে পড়।”

 দূত বেগতিক দেখে সরে পড়ল।

 রাজা হেসে বললেন, “যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! দুশো পাঁচশো হত, তবু নাহয় বুঝতাম; দারোয়ানগুলোর খোরাক থেকে দু-চারদিন কিছু কেটে রাখলেই টাকাটা উঠে যেত। কিন্তু তাতে তো ওদের পেট ভরবে না, একেবারে দশ হাজার টাকা হেঁকে বসল! ছোটলোকের একশেষ!”

 শুনে পাত্র-মিত্র সবাই মিলে ‘হুঁ-হুঁ’ করল, কিন্তু মনে মনে সবাই বলল—“ছি ছি, কাজটা অতি খারাপ হল!”

 দিন দুই বাদে কোথা থেকে এক বুড়ো সন্ন্যাসী এসে রাজসভায় হাজির; সন্ন্যাসী এসেই রাজাকে আশীর্বাদ করে বললেন, “দাতাকণ মহারাজ! ফকিরের ভিক্ষা পূর্ণ করতে হবে।”

 রাজা বললেন, “ভিক্ষার বহরটা আগে শুনি। কিছু কমসম করে বললে হয়তো-বা পেতেও পারেন।”

 সন্ন্যাসী বললেন, “আমি ফকির মানুষ, আমার বেশি দিয়ে  দরকার কি? আমি অতি যৎকিঞ্চিৎ সামান্য ভিক্ষা একটি মাস ধরে প্রতিদিন রাজভাণ্ডারে পেতে চাই। আমার ভিক্ষা নেবার নিয়ম এই—প্রথম দিন যা নিই, দ্বিতীয় দিন নিই তার দ্বিগুণ, তৃতীয় দিনে তারও দ্বিগুণ, আবার চতুর্থ দিনে তৃতীয় দিনের দ্বিগুণ। এমনি করে প্রতিদিন দ্বিগুণ করে নিই, এই আমার ভিক্ষার রীতি।”

 রাজা বললেন, “তা তো বেশ বঝেলাম। কিন্তু প্রথম দিন কত চান সেইটাই হল আসল কথা। দু-চার টাকায় পেট ভরে তো ভালো কথা, নইলে একেবারে বিশ-পঞ্চাশ হেঁকে বসলে সে যে অনেক টাকার মামলায় গিয়ে পড়তে হবে।”

 সন্ন্যাসী একগাল হেসে বললেন, “মহারাজ, ফকিরের কি লোভ থাকে? আমি বিশ পঞ্চাশও চাই নে, দু-চার টাকাও চাই নে। আজ আমায় একটি পয়সা দিন, তারপর উনত্রিশ দিন দ্বিগুণ করে দেবার হুকুম দিন।”

 শুনে রাজা মন্ত্রী পাত্র-মিত্র সবাই প্রকাণ্ড দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তখনি চটপট হুকুম হয়ে গেল, সন্ন্যাসী ঠাকুরের হিসাবমত রাজভাণ্ডার থেকে এক মাস তাঁকে ভিক্ষা দেওয়া হোক। সন্ন্যাসী ঠাকুর মহারাজের জয়-জয়কার করে বাড়ি ফিরলেন।

 রাজার হুকুমমত রাজ-ভাণ্ডারী প্রতিদিন হিসাব করে সন্ন্যাসীকে ভিক্ষা দেয়। এমনি করে দুদিন যায় দশদিন যায়। দু সপ্তাহ ভিক্ষা দেবার পর ভাণ্ডারী হিসাব করে দেখল ভিক্ষাতে অনেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখে তার মন খুঁৎ খুঁৎ করতে

দেশ-বিদেশের গল্প
১২৭