পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/১৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এমনি করেই দিন কেটে যায়, এমনি করেই বছর ফুরোয়। হঠাৎ একদিন সকাল বেলায় গ্রাম জুড়ে এই রব উঠল, “ব্যাঙ এসেছে, ব্যাঙ এসেছে। ছাতা নিতে ব্যাঙ এসেছে।”

 কোথায় ব্যাঙ? কে দেখেছে? বনের ধারে ছাতার তলায়; লালু দেখেছে, কালু দেখেছে, চাঁদা ভোঁদা সবাই দেখেছে। কি করছে ব্যাঙ? কিরকম ব্যাঙ? লালু বলল, “পাটকিলে লাল ব্যাঙ–যেন হলুদগোলা চুন। এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।” কাল বলল, “ছাইয়ের মতন ফ্যাক্‌সা রঙ, এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।” চাঁদা বলল, “চক্‌চকে সবুজ, যেন নতুন কাঁচ ঘাস—এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।” ভোঁদা বলল, “ভুসো-ভুসো রঙ, যেন পুরোনো তেঁতুল-তেঁতুল—এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।”

 গ্রামের যত বুড়ো, যত মহা-মহা পণ্ডিত সবাই বলল, “কারুর সঙ্গে কারুর মিল নেই। তোরা কি দেখেছিস আবার বল।” লালু কালু, চাঁদা ভোঁদা সবাই বললে, “ছাতার তলায় জ্যান্ত ব্যাঙ, তার চার হাত লম্বা ল্যাজ!” শুনে সবাই মাথা নেড়ে বলল, “উঁহুঁ উঁহুঁ! তাহলে কক্ষনো সেটা ব্যাঙ নয়, সেটা বোধহয় ব্যাঙের বাচ্চা ব্যাঙাচি। তা নইলে ল্যাজ থাকবে কেন?”

 ব্যাঙ না হোক, ব্যাঙের ছেলে তো বটে—ছেলে না হোক নাতি, কিবা ভাইপো, কিবা ব্যাঙের কেউ তো বটে। সবাই বললে, “চল্‌ চল্‌ দেখবি চল্‌।” সবাই মিলে দৌড়ে চলল।

 মাঠের পারে, বনের ধারে, ব্যাঙ-ছাতার আগায় বসে কে একজন রোদ পোয়াচ্ছে। রঙটা যেন শ্যাওলা-ধরা গাছের বাকল, ল্যাজখানা তার ঘাসের ওপর ঝুলে পড়েছে, এক চোখ বুজে এক চোখ খুলে একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে। সবাই তখন চেঁচিয়ে বললে, “তুমি কে হে? কস্ত্বত্বম্‌? তুম্‌ কোন্‌ হায়? হু আর ইউ?” শুনে সে ডাইনেও তাকালে না, বাঁয়েও তাকালে না, খালি একবার রঙ বদলে খোলা চোখটা বুজলে আর বোজা চোখটা খুললে, আর চিড়িক করে এক হাত লম্বা জিভ বার করেই তক্ষুনি আবার গুটিয়ে নিলে।

 গ্রামের যে হোম্‌রা বুড়ো, সে বলল, “মোড়ল ভাই, ওটা যে জবাব দেয় না? কালা নাকি?” মোড়ল বলল, “হবেও বা।” সর্দার খুড়ো সাহস করে বলল, “চল না ভাই, এগিয়ে যাই, কানের কাছে চেঁচিয়ে বলি।” মোড়ল বলল, “ঠিক বলেছ।” হোম্‌রা বলল, “তোমরা এগোও। আমি এই আঁকশি নিয়ে ঐ ঝোপের মধ্যে উঁচিয়ে বসি। যদি কিছু করতে আসে, ঘ্যাঁচাৎ ক’রে কুপিয়ে দেব।”

 তখন সর্দার সেই ছাতার ওপর উঠে ল্যাজওয়ালাটার কানের কাছে হঠাৎ “কোন হ—া—য়্‌” বলে এম্‌নি জোরে হাঁকড়ে উঠল যে, সেটা আরেকটু হলেই ছাতার থেকে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হ’য়ে থেকে, দুচোখ তাকিয়ে বলল, “উঃ? অত চেঁচান কেন মশাই? আমি কি কালা?” তখন সর্দার নরম হ’য়ে বলল, “তুমি ব্যাঙের কেউ হও না?” জন্তুটা তখন “না-না-না-না—কেউ না—কেউ না—কেউ না” ব’লে দুই চোখ বুজে ভয়ানক রকম দুলতে লাগল।

 তাই না দেখে সর্দার বুড়ো চিৎকার করে বলল, “তবে যে তুমি ছাতা নিতে এসে?” সঙ্গে সঙ্গে সবাই চেঁচাতে লাগল, “নেমে এসো, নেমে এসো—শিগ্‌গির নেমে এসো।” মোড়ল খুড়ো ছুট্টে গিয়ে প্রাণপণে তার ল্যাজটা ধরে টানতে লাগল।

১৭৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী