পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পাকাতে—সেগুলো পাড়াময় ছড়িয়ে দিলেই ইঁদুরবংশ নির্বংশ হবে!” হরিপদ জিজ্ঞাসা করলো, “লাড়ু কবে পাকানো হবে?” বড়মামা বললেন, “সে এতক্ষণে হয়ে গেছে—সকালেই টেঁপিকে দেখছিলাম একতাল ক্ষীর নিয়ে দিদির সঙ্গে লাড়ু পাকাতে বসেছে।” হরিপদর মুখখানা আমসির মতো শুকিয়ে এলো—সে খানিকটা ঢোক গিলে বলল, “সেঁকোবিষ খেলে কি হয়, বড়মামা?” “হবে আবার কি? ইঁদুরগুলো মারা পড়ে, এই হয়।” “আর যদি মানুষ ঐ লাড়ু খেয়ে ফেলে?” “তা, একটু আধটু যদি খেয়ে ফেলে তো নাও মরতে পারে—গলা জ্বলবে, মাথা ঘুরবে, বমি হবে, হয়তো হাত-পা খিঁচবে।” “আর যদি একেবারে এগারোটা লাড়ু খেয়ে ফেলে?” বলে হরিপদ ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে ফেলল। তখন বড়মামা হাসি চেপে অত্যন্ত গভীর হয়ে বললেন, “বলিস কিরে! তুই খেয়েছিস নাকি?” হরিপদ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “হ্যাঁ বড়মামা, তার মধ্যে সাতটা খুব বড়-বড় ছিল। তুমি শিগ্গির ডাক্তার ডাকো, বড়মামা—আমার কিরকম গা ঝিম ঝিম আর বমি বমি করছে!”

 মেজমামা দৌড়ে গিয়ে তাঁর বন্ধু রমেশডাক্তারকে পাশের বাড়ি থেকে ডেকে আনলেন। তিনি এসে প্রথমেই খুব একটা কড়া রকমের তিতো ওষুধ হরিপদকে খাইয়ে দিলেন। তারপর তাকে কি একটা শুঁকতে দিলেন, তার এমন ঝাঁজ যে, বেচারার দুই চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। তারপর তাঁরা সবাই মিলে লেপকম্বল চাপা দিয়ে তাকে ঘামিয়ে অস্থির করে তুললেন। তারপর আরেকটা ভয়ানক উৎকট ওষুধ খাওয়ানো হলো, সে এমন বিস্বাদ আর এমন দুর্গন্ধ যে খেয়েই হরিপদ ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে লাগল।

 তারপর ডাক্তার তার পথ্যের ব্যবস্থা করে গেলেন। তিনদিন সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না; চিরেতার ঝোল আর সাগু খেয়ে থাকবে। হরিপদ বলল, “আমি ওপরে মার কাছে যাব।” ডাক্তার বললেন, “না। যতক্ষণ বাঁচবার আশা আছে ততক্ষণ নাড়াচাড়া করে কাজ নেই। ও আপনাদের এখানেই থাকবে।” বড়মামা বললেন, “হাঁ! মার কাছে যাবে, না আরো কিছু? মাকে এখন ভাবিয়ে তুলে তোমার লাভ কি? তাঁকে এখন খবর দেবার কিছু দরকার নেই।”

 তিনদিন পরে যখন সে ছাড়া পেলো তখন হরিপদ আর সেই হরিপদ নেই—সে একেবারে বদলে গেছে। তার বাড়ির লোকে সবাই জানে হরিপদর ভারি ব্যারাম হয়েছিল—তার মা জানেন যে বেশি পিঠে খেয়েছিল বলে হরিপদর পেটের অসুখ হয়েছিল—হরিপদ জানে সেঁকোবিষ খেয়ে সে আরেকটু হলেই মারা যাচ্ছিল। কিন্তু আসল ব্যাপারটা যে কি, তা জানে কেবল হরিপদর বড়মামা আর মেজমামা, আর জানে রমেশডাক্তার—আর এখন জানলে তোমরা, যারা এই গল্প পড়ছ।

সন্দেশ—১৩২৪
১৮৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী