দিয়ে নামবার সময় তার সে কথা মনে রইলো না; সে দুতিন সিঁড়ি ডিঙিয়ে নামতে লাগলো! শেষকালে চটির হাঁ বেড়ে বেড়ে সমস্ত দাঁত বের করে ভ্যাংচাতে লাগলো! যেমনি সে শেষ তিনটে সিঁড়ি ডিঙিয়ে লাফিয়ে পড়েছে, অমনি মাটিটা তার পায়ের নীচ থেকে সুড়ুৎ করে সরে গেল আর ছেঁড়া চটি তাকে নিয়ে সাঁই সাঁই করে শূন্যের ওপর দিয়ে কোথায় যে ছটে চলল তার ঠিকঠিকানা নেই।
ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে চটি যখন থামলো, তখন যতীন দেখলো সে কোন্ অচেনা দেশে এসে পড়েছে। সেখানে চারদিকে অনেক মুচি বসে আছে। তারা যতীনকে দেখে কাছে এলো, তারপর তার পা থেকে ছেঁড়া চটিজোড়া খুলে নিয়ে সেগুলোকে যত্ন করে ঝাড়তে লাগলো। তাদের মধ্যে একজন মাতব্বরগোছের, সে যতীনকে বলল, “তুমি দেখছি ভারি দুষ্টু। জুতোজোড়ার এমন দশা করেছ? দেখ দেখি, আরেকট হলে বেচারিদের প্রাণ বেরিয়ে যেত।” যতীনের ততক্ষণে একটু সাহস হয়েছে। সে বলল, “জুতোর আবার প্রাণ থাকে নাকি?” মুচিরা বলল, “তা না তো কি? তোমরা বুঝি মনে কর তোমরা যখন জুতো পায়ে দিয়ে জোরে জোরে ছোটো তখন ওদের লাগে না? খুব লাগে। লাগে বলেই তো ওরা মচমচ করে। যখন তুমি চটি পায়ে দিয়ে দুড়দুড় করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেছিলে আর তোমার পায়ের চাপে ওর পাশ কেটে গেছিল, তখন কি ওর লাগে নি? খুব লেগেছিল। সেইজন্যই ও তোমাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে। যত রাজ্যের ছেলেদের জিনিসপত্রের ভার আমাদের ওপর। তারা সে-সবের অযত্ন করলে আমরা তাদের শিক্ষা দিই।” মুচি যতীনের হাতে ছেঁড়া চটি দিয়ে বলল, “নাও, সেলাই কর।” যতীন রেগে বলল, “আমি জুতো সেলাই করি না, মুচিরা করে।” মুচি একটা হেসে বলল, “এ কি তোমাদের দেশ পেয়েছ যে ‘করব না’ বললেই হল! এই ছুঁচসুতো নেও, সেলাই কর।” যতীনের রাগ তখন কমে এসেছে, তার মনে ভয় হয়েছে। সে বলল, “আমি জুতো সেলাই করতে জানি না।” মুচি বলল, “আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, সেলাই তোমাকে করতেই হবে।” যতীন ভয়ে ভয়ে জুতো সেলাই করতে বসলো। তার হাতে ছুঁচ ফুটে গেল, ঘাড় নিচু করে থেকে থেকে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেল, অনেক কষ্টে সারাদিনে একপাটি চটি সেলাই হলো। তখন সে মুচিকে বলল, “কাল অন্যটা করব। এখন খিদে পেয়েছে।” মুচি বলল, “সে কি! সব কাজ শেষ না করে তুমি খেতেও পাবে না, ঘুমোতেও পাবে না। একপাটি চটি এখনো বাকি আছে। তারপর তোমাকে আস্তে আস্তে চলতে শিখতে হবে, যেন আর কোন জুতোর ওপর অত্যাচার না কর। তারপর দর্জির কাছে গিয়ে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করতে হবে। তারপর আর কি কি জিনিস নষ্ট করেছ দেখা যাবে।”
যতীনের তখন চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে কাঁদতে কাঁদতে কোনরকমে অন্য চটিটা সেলাই করলো। ভাগ্যে এ পাটি বেশি ছেঁড়া ছিল না। তখন মুচিরা তাকে একটা পাঁচতলা উচু বাড়ির কাছে নিয়ে গেল। সে বাড়িতে সিঁড়ি বরাবর একতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। তারা যতীনকে সিঁড়ির নীচে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, “যাও, একেবারে পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে যাও, আবার নেমে এসো। দেখ, আস্তে আস্তে একটি একটি সিঁড়ি উঠবে নামবে।” যতীন পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে গিয়ে নেমে এল। সে নীচে আসলে মুচিরা বলল, “হয় নি। তুমি তিনবার দুটো সিঁড়ি একসঙ্গে উঠেছ, পাঁচবার লাফিয়েছ, দুবার তিনটে করে সিঁড়ি