পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চিকিৎসা শিখিয়াছেন—কিন্তু সে বিষবাণ এমন সাংঘাতিক, তাহার কাছে কোন চিকিৎসাই খাটিল না। চীরণ আর বাঁচিলেন না। এবার হারকিউলিস তাঁহার কাজ সারিয়া, নিতান্ত বিষণ্ণ মনে গুরুর কথা ভাবিতে ভাবিতে দেশে ফিরিলেন।

 হারকিউলিস একা সেণ্টরদের যুদ্ধে হারাইয়াছেন, এই সংবাদ চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। সকলে বলিল, “হারকিউলিস না জানি কত বড় বীর! এমন আশ্চর্য কীর্তির কথা আমরা আর শুনি নাই।” আসলে কিন্তু হারকিউলিসের বড়-বড় কাজ এখনো কিছুই করা হয় নাই—তাঁহার কীর্তির পরিচয় সবেমাত্র আরম্ভ হইয়াছে।

 বরাহ মারিয়া হারকিউলিস অল্পই বিশ্রাম করিবার সুযোগ পাইলেন—কারণ তাহার পরেই এলিস নগরের রাজা আগিয়াসের গোয়ালঘর সাফ করিবার জন্য তাঁহার ডাক পড়িল। আগিয়াসের প্রকাণ্ড গোয়ালঘরে অসংখ্য গরু, কিন্তু বহু বৎসর ধরিয়া সে ঘর কেহ ঝাঁট দেয় না, ধোয় না—সুতরাং তাহার চেহারাটি তখন কেমন হইয়াছিল, তাহা কল্পনা করিয়া দেখ। গোয়ালঘরের অবস্থা দেখিয়া হারকিউলিস ভাবনায় পড়িলেন। প্রকাণ্ড ঘর, তাহার ভিতর হাঁটিয়া দেখিতে গেলেই ঘণ্টাখানেক সময় যায়। সেই ঘরের ভিতর হয়ত বিশ বৎসরের আবর্জনা জমিয়াছে—অথচ একজন মাত্র লোকে তাকে সাফ করিবে, ঘরের কাছ দিয়া আলফিউস্‌ নদী স্রোতের জোরে প্রবল বেগে বহিয়া চলিয়াছে—হারকিউলিস ভাবিলেন—‘এই তো চমৎকার উপায় হাতের কাছেই রহিয়াছে!’ তিনি তখন একাই গাছ পাথরের বাঁধ বাঁধিয়া স্রোতের মুখ ফিরাইয়া, নদীটাকে সেই গোয়ালঘরের উপর দিয়া চালাইয়া দিলেন। নদী হু হু শব্দে নূতন পথে বহিয়া চলিল, বিশ বৎসরের জঞ্জাল মুহূর্তের মধ্যে ধুইয়া সাফ হইয়া গেল। তাহার পর যেখানকার নদী সেখানে রাখিয়া তিনি দেশে ফিরিলেন।

 এদিকে ক্রীটদ্বীপে আর এক বিপদ দেখা দিয়াছে। জলের দেবতা নেপচুন সে দেশের রাজাকে এক প্রকাণ্ড ষাঁড় উপহার দিয়া বলিয়াছেন, “এই জন্তুটিকে তুমি দেবতার নামে উৎসর্গ করিয়া বলি দাও।” কিন্তু ষাঁড়টি এমন আশ্চর্যরকম সুন্দর যে, তাহাকে বলি দিতে রাজার মন সরিল না—তিনি তাহার বদলে আর-একটি ষাঁড় আনিয়া বলির কাজ সারিলেন। নেপচুন সমুদ্রের নীচে থাকিয়াও এ-সমস্তই জানিতে পারিলেন। তিনি তাঁহার ষাঁড়কে আদেশ দিলেন, “যাও! এই দুষ্টু রাজার রাজ্য ধ্বংস কারিয়া ইহার অবাধ্যতার সাজা দাও।” নেপচুনের আদেশ সেই সর্বনেশে ষাঁড় পাগলের মত চারিদিকে ছুটিয়া সারাটি রাজ্য উজাড় করিয়া ফিরিতেছে। একে দেবতার ষাঁড়, তাহার উপর যেমন পাহাড়ের মতো দেহখানি, তেমনই আশ্চর্য তাহার শরীরের তেজ—কাজেই রাজ্যের লোক প্রাণভয়ে দেশ ছাড়িয়া পলাইবার জন্য ব্যস্ত। এমন জন্তুকে বাগাইবার জন্য তো হারকিউলিসের ডাক পড়িবেই। হারকিউলিসও অতি সহজেই তাকে শিঙ ধরিয়া মাটিতে আছড়াইয়া একেবারে পোঁটলা বাঁধিয়া রাজসভায় নিয়া হাজির করিলেন। রাজা ইউরিসথিউসের মেয়ে বাপের বড় আদুরে। সে একদিন আব্দার ধরিল তাকে হিপোলাইটের চন্দ্রহার আনিয়া দিতে হইবে। হিপোলাইট এসেজনদের রানী। এসেজনদের দেশে কেবল মেয়েদেরই রাজত্ব। বড় সর্বনেশে মেয়ে তাহারা—সর্বদাই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত, পৃথিবীর কোন মানুষকে তাহারা ডরায় না। কিন্তু হারকিউলিসকে তাহারা খুব খাতির সম্মান করিয়া তাহাদের রানীর কাছে লইয়া গেল। হারকিউলিস তখন রানীর কাছে তাঁহার প্রার্থনা জানাইলেন। রানী বলিলেন, “আজ তুমি খাও-দাও, বিশ্রাম কর, কাল অলংকার লইতে আসিও।”

৮৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী