বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লিসের কাছে খুব খানিক চড়চাপড় খাইয়া, সে ষাঁড়ের মূর্তি ধরিয়া তাঁহাকে গুঁতাইতে আসিল। হারকিউলিস তখন তাহার শিঙ ভাঙ্গিয়া দিতেই, সে পলাইয়া আবার আর এক মূর্তিতে ফিরিয়া আসিল। এইরূপ বহুক্ষণ যুদ্ধের পর হারকিউলিস তাহাকে এমন কাবু করিয়া ফেলিলেন যে, প্রাণের দায়ে সে দেশ ছাড়িয়া চম্পট দিল।

 তারপর হারকিউলিস ডেয়ানিরাকে বিবাহ করিয়া তাঁহার সঙ্গে দেশ-ভ্রমণে বাহির হইলেন। কত রাজ্য কত দেশ ঘুরিয়া, একদিন তাঁহারা এক প্রকাণ্ড নদীর ধারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নদীতে ভয়ানক স্রোত দেখিয়া হারকিউলিস ডেয়ানিরাকে পার করিবার উপায় ভাবিতেছেন; এমন সময়ে নেসাস নামে এক বুড়ো সেণ্টর (মানুষ ঘোড়া) আসিয়া বলিল, “আমি এই মেয়েটিকে পিঠে করিয়া পার করিয়া দিব।” ডেয়ানিরা সেণ্টরের পিঠে চড়িয়া নদী পার হইলেন, হারকিউলিসও এক হাতে তাঁহার তীর ধনুক জল হইতে উঠাইয়া, আর এক হাতে ঢেউ ঠেলিয়া পার হইতে লাগিলেন। নদীর ওপারে গিয়া হতভাগা নেসাস ভাবিল, ‘আহা! এমন সুন্দরী মেয়ে কেন এই মানুষটার সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়ায়? তাহার চাইতে ইহাকে লইয়া আমাদের দেশে পলাইয়া যাই না?’ এই ভাবিয়া সে ডেয়ানিরাকে লইয়া এক ছুট্‌ দিল। ডেয়ানিরার চিৎকারে হারকিউলিস মাথা তুলিয়া চাহিলেন, এবং তৎক্ষণাৎ জলের ভিতর হইতেই তীর ছুঁড়িয়া নেসাসের মর্মভেদ করিয়া ফেলিলেন। মরিবার সময় দুষ্টু সেণ্টর অত্যন্ত ভালো মানুষের মতো অনেক অনুতাপ করিয়া ডেয়ানিরাকে বলিয়া গেল, “আমার ঘাড়ের উপর হইতে এই জামাটি খুলিয়া তুমি রাখিয়া দাও। যদি তোমার স্বামীর ভালোবাসা কোনদিন কমিতে দেখ, তবে এই জামা তাহাকে পরাইলেই তাহার সমস্ত ভালোবাসা আবার ফিরিয়া আসিবে।” ডেয়ানিরা তাহাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়া জামাটি পরম যত্নে লুকাইয়া রাখিলেন। ততক্ষণে হারকিউলিসও নদী পার হইয়া আসিয়াছেন, দুইজনে আবার চলিতে লাগিলেন।

 তাহার পর কত বৎসর কাটিয়া গেল। একদিন কি একটা কাজের জন্য দূর দেশের এক রাজসভায় হারকিউলিসের যাওয়া দরকার হইল। তিনি ডেয়ানিরাকে রাখিয়া সেই যে বাহির হইলেন, তাহার পর কতদিন গেল, কত মাস গেল, হারকিউলিস আর ফিরেন না। ডেয়ানিরা ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, ভাবিতে লাগিলেন, “তবে কি হারকিউলিস আমায় ভুলিয়া গেলেন? আর কি তিনি আমায় ভালোবাসেন না?” তিনি দূত পাঠাইলেন, তাহারা আসিয়া বলিল, “হারকিউলিস বেশ ভালোই আছেন—রাজসভায় নানা আমোদ-প্রমোদে তাঁহার দিন কাটিতেছে।” শুনিয়া ডেয়ানিরা সেই সেণ্টরের দেওয়া জামাটি বাহির করিলেন। সোনার মত ঝক্‌ঝকে জামা, সেণ্টরের মৃত্যু-সময়ে রক্তে ভিজিয়া গিয়াছিল—কিন্তু এখন তাহাতে রক্তের চিহ্নমাত্র নাই। সেই জামা তিনি লাইকাস নামে এক দূতকে দিয়া হারকিউলিসের কাছে পাঠাইয়া দিলেন—ভাবিলেন, তাহা হইলে হারকিউলিসকে শীঘ্র ফিরিয়া পাইবেন। জামার কাহিনী তো হারকিউলিস জানেন না, সেণ্টরের রক্তে যে তাহা বিষাক্ত হইয়া আছে, এরূপ সন্দেহও তাঁহার মনে জাগিল না, তিনি নিশ্চিন্ত মনে সেই জামা পরিলেন। জামা পরিবামাত্র তাঁহার সর্বাঙ্গ জ্বলিতে লাগিল, তাঁহার শিরায় শিরায় যেন আগুনের প্রবাহ ছুটিতে লাগিল। তিনি তাড়াতাড়ি জামা ছাড়াইতে গিয়া দেখেন যে সর্বনাশ, জামা তাঁহার শরীরের মধ্যে বসিয়া গিয়াছে; গায়ের চামড়া উঠিয়া আসে, তবু জামা ছাড়িতে চায়

দেশ-বিদেশের গল্প
৯৩