পারসীক গল্প/বিচার সঙ্কট

উইকিসংকলন থেকে


পারসীক গল্প।


বিচার-সঙ্কট।


 কোন সহরে দুইটী স্ত্রীলোক আসিয়া অতি অল্প দিবস হইতে বাস করে। উহাদিগের একজনের নাম ফাতেমা, অপরটীর নাম নছিবন। ফতেমা ও নছিবন উভয়েই উজীর নামক একজনের স্ত্রী। উজীর কার্য্যোপলক্ষে বহু দিবস পর্য্যন্ত দূর দেশে বাস করিতেন, তাঁহার পত্নীদ্বয় ফাতেমা ও নছিবন সর্ব্বদাই তাহার নিকটে থাকিত। কর্ম্মস্থানেই উজীরের মৃত্যু হয়, মৃত্যুকালীন তিনি একটী মাত্র শিশু সন্তান রাখিয়া যান। তাঁহার মৃত্যুর পর ফতেমা ও নছিবন বর্ত্তমান সহরে আসিয়া বাস করে। এই স্থানে আসিবার পরই উভয়ের মধ্যে উক্ত বালক লইয়া ভয়ানক কলহ উপস্থিত হয়। ফাতেমা কহে যে, সে বালক তাহার সন্তান। নছিবন কহে যে, সে ফতেমার পুত্র নহে, তাহার পুত্র। প্রতিবেশীগণ প্রথমে এই বিবাদ ভঞ্জন করিবার নির্মিত বিশেষরূপে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উক্ত বালকটী যে কাহার সন্তান, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারায়, বিবাদের মীমাংসা করিয়া উঠিতে পারিলেন না। পরিশেষে তাঁহারা উভয়কেই কাজি সাহেবের নিকট গিয়া নালিশ করিতে পরামর্শ দিলেন। এই পরামর্শ অনুযায়ী উভয়েই কাজির নিকট গিয়া উক্ত বালকের নিমিত্ত আপনাপন অভিযোগ উপস্থিত করিল। কাজি সাহেব প্রথমে ফতেমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বালকটী কাহার গর্দ্ভজাত? বল, মিথ্যা বলিও না। মিথ্যা বলিলে আমার নিকট হইতে তোমাকে কঠিন দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে।”

 ফতেমা। দোহাই ধর্ম্মাবতার! আমি মিথ্যা কথা বলিতেছি না, এ আমার পুত্র। নছিবন মিথ্যা করিয়া আমার পুত্রকে গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিতেছে।

 কাজি। দেখ নছিবন। আমি তোমাকেও বলিতেছি, তুমি আমার নিকট মিথ্যা কথা কহিও না। এ পুত্র কাহান গর্দ্ভজাত, তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান কর।

 নছিবন। দোহাই হুজুর! আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, এ পুত্র আমার।

 কাজি। সাক্ষ্য সাবুদ দ্বারা তোমরা কে প্রমাণ করিতে পারিবে যে, এই পুত্র কাহার?

 ফতেমা। এখানে আমরা সাক্ষী কোথায় পাইব?

 নছিবন। পুত্র এ স্থানে জন্মায় নাই, বা আমাদিগের স্বামীও বর্ত্তমান নাই, এ রূপ অবস্থায় এ পুত্র যে আমার, কোন সাক্ষী দ্বারা তাহা প্রমাণ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।

 কাজি। যখন কোন রূপ প্রমাণের দ্বারা তোমাদিগের মধ্যে কেহই প্রমাণ করিতে পারিবে না যে, এই পুত্র কাহার, তখন আমি প্রকৃত বিচার করিয়া তোমাদিগের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া দিতেছি।

 এই বলিয়া কাজি সাহেব তাঁহার জল্লাদকে সেই স্থানে ডাকাইলেন। সংবাদ পাইবামাত্র জল্লাদ যোড় আসিয়া কাজি সাহেবের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। জল্লাদকে দেখিয়া কাজি সাহেব তাহাকে কহিলেন, “এই বালকটা লইয়। এই স্ত্রীলোক-দ্বয়ের মধ্যে ভয়ানক বিবাদ উপস্থিত হইয়াছে। উভয়েই এই পুত্রকে আপনাপন গর্ভজাত পুত্র বলিয়া আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু সাক্ষ্যাদির দ্বারা কোন রূপে প্রমাণ করিতে পারিতেছে না যে, এই পুত্র কাহার গর্ভজাত। অথচ উভয়েই স্বীকার করিতেছে যে, এই পুত্র ইহাদিগের স্বামী উজীরের ঔরসজাত। এরূপ অবস্থায় আমার বিচারে উজীরের উভয় পত্নীই তাঁহার একমাত্র পুত্রের সমান অংশীদার। তুমি এই পুত্রের দুই পা দুইদিকে ধরিয়া চিরিয়া সাবধানে ঠিক তুল্যাংশে উহাকে দুই ভাগে বিভক্ত কর। এক এক অংশ উভয় অংশীদারের এক একজনকে প্রদান কর।”

 “হুজুরের আড্ডা শিরোধার্য্য,” এই কথা বলিয়া জল্লাদ সেই পুত্রকে আপন স্কন্ধে উঠাইয়া লইয়া, বধ্যভূমি অভিমুখে প্রস্থান করিল।

 সেই সময় কাজি সাহেব পুনরায় ফতেমাকে সম্বোধন করিয়া করিলেন, “কেমন ফতেমা! আমি এখন কেমন বিচার করিয়া দিলাম! এখন হুইতে তোমাদিগের সমস্ত বিবাদ মিটিয়া যাইবে।”

 কাজি সাহেবের কথা শুনিয়া, ফতেমা কহিল “ধর্ম্মাবতারের বিচারে কথা কহিবার ক্ষমতা কাহার আছে? আপনি যাহা আড্ডা করিবেন, তাহাই আমাদিগের শিরোধার্য্য।”

 সেই সময় নছিবন অশ্রুপূর্ণলোচনে করযোড়ে দণ্ডায়মানা হইয়া কহিল, “ধর্ম্মাবতার! আমার একটী কথা বলিবার আছে। আপনি আপনার জল্লাদকে ওই পুত্র-হত্যা করিতে নিষেধ করুন। আমি বুঝিতে না পারিয়া আপনার কাছে মিথ্যা কথা কহিয়াছি। এ পুত্র আমার নহে, উহা ফতেমার। অতএব, পুত্রের প্রাণবধ না করিয়া আপনি ফতেমাকে ঐ পুত্র প্রদান করুন।”

 নছিবনের এই কথা শুনিয়া, কাজি সাহেব তখন বুঝিতে পারিলেন, এ পুত্র কাহার গর্ভজাত, ও এই পুত্রশোকে কাহার হৃদয় দগ্ধ করিবে। তিনি তৎক্ষণাৎ জল্লাদের নিকট হইতে উক্ত পুত্রটীকে আনাইয়া নছিবনের হস্তে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, “আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছি, ফতেমা মিথ্যা কথা কহিতেছে। এ পুত্র তাহার নহে, তোমার। তুমি তোমার শিশু সন্তানকে লইয়া প্রস্থান করিতে পার। আর আমার নিকট মিথ্যা কথা কহিবার নিমিত্ত ফাতেমা কিয়দ্দিবসের নিমিত্ত কারাবদ্ধা থাকিবে। কিন্তু এখনও যদি সে আমার নিকট সত্য কথা কহে, তাহা হইলে আমি তাহাকে অব্যাহতি প্রদান করিব; নচেৎ কিয়দ্দিবসের জন্য জেলের মধ্যে তাহার স্থান করিয়া দিব।”

 কাজি সাহেবের এই কথা শুনিবামাত্র ফতেমা কাঁদিয়া ফেলিল, ও কহিল “দোহাই ধর্ম্মাবতার! আমাকে আর দণ্ড প্রদান করিবেন না, এ পুত্র আমার নহে, এ নছিবনের গর্ভে জন্মাইয়াছে। কিন্তু আমি মিথ্যা করিয়া যাহাতে পুত্রটী লইতে পারি, তাহার চেষ্টা করিতেছিলাম! ধর্ম্মাবতার! এখন জানিতে পারিলাম, আপনার নিকট মিথ্যা বলিয়া পার পাইবার উপায় নাই। আপনি প্রকৃত বিচারই করিয়াছেন।”

 ফতেমার এই কথা শুনিয়া, কাজি সাহেব তাহাকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন। উভয়েই হৃষ্টমনে আপনাপন স্থানে প্রস্থান করিল।