পুনশ্চ/ক্যামেলিয়া

উইকিসংকলন থেকে

ক্যামেলিয়া

নাম তার কমলা।
দেখেচি তার খাতার উপরে লেখা,
সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।
আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।
মুখের একপাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,
আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে।
কোলে তার ছিল বই আর খাতা।
যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হোলো না।

এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই,—
সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না,
প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরবার সময়ের সঙ্গে,
প্রায়ই হয় দেখা।
মনে মনে ভাবি আর কোনো সম্বন্ধ না থাক্‌
ও তো আমার সহযাত্রিণী।
নির্ম্মল বুদ্ধির চেহারা
ঝকঝক্ করচে যেন!
সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা,
উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসঙ্কোচ।
মনে ভাবি একটা কোনো সঙ্কট দেখা দেয় না কেন
উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি,—
রাস্তার মধ্যে একটা কোনো উৎপাত,
কোনো একজন গুণ্ডার সর্দ্দার।
এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে।
কিন্তু আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা,
বড়ো রকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে,
নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে,
না সেখানে হাঙর কুমীরের নিমন্ত্রণ, না রাজহাঁসের।


একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়,
কমলার পাশে বসেচে একজন আধা-ইংরেজ।
ইচ্ছে করছিল অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে।
ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।
কোনো ছুতো পাইনে, হাত নিষপিষ করে।

এমন সময় সে এক মোটা চুরট ধরিয়ে
টানতে করলে সুরু।
কাছে এসে বল্‌লুম, ফেলো চুরট।
যেন পেলেই না শুনতে,
ধোঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে।
মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরট রাস্তায়।
হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কটমট করে,
আর কিছু বল্‌লে না, এক লাফে নেমে গেল।
বোধ হয় আমাকে চেনে।
আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়,
বেশ একটু চওড়া গোছের নাম।
লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ,
বই খুলে মাথা নীচু করে ভান করলে পড়বার।
হাত কাঁপতে লাগল,
কটাক্ষেও তাকালে না ধীরপুরুষের দিকে।
আপিসের বাবুরা বল্‌লে, বেশ করেছেন মশায়।
একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়,
একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে।
পরদিন তাকে দেখলুম না,
তার পরদিনও না,
তৃতীয় দিনে দেখি
একটা ঠেলাগাড়িতে চলেচে কলেজে।
বুঝলুন, ভুল করেচি গোঁয়ারের মতো।
ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে,
আমাকে কোনো দরকারই ছিল না।

আবার বললুম মনে মনে,
ভাগ্যটা ঘোলাজলের ডোবা,—
বীরত্বের স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলি আজ আওয়াজ করচে,
ঠাট্টার মতো।
ঠিক করলুম ভুল শোধরাতে হবে।


খবর পেয়েচি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দাৰ্জ্জিলিঙে।
সে-বার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরী দরকার।
ওদের ছোট্ট বাসা, নাম দিয়েচে মতিয়া,—
রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণে,
গাছের আড়ালে,
সামনে বরফের পাহাড়।
শোনা গেল আসবে না এবার।
ফিরব মনে করচি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে দেখা,
মোহন লাল, —
রোগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চষমা,
দুর্ব্বল পাকযন্ত্র দাৰ্জ্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায়।
সে বললে, “তনুকা আমার বোন,
কিছুতে ছাড়বে না, তোমার সঙ্গে দেখা না করে।”
মেয়েটি ছায়ার মতো,
দেহ যতটুকু না হলে নয় ততটুকু,—
যতটা পড়াশোনায় ঝোঁক, আহারে ততটা নয়।
ফুটবলের সর্দারের পরে তাই এত অদ্ভুত ভক্তি,—
মনে করলে, আলাপ করতে এসেচি সে আমার দুর্লভ দয়া।
হায়রে ভাগ্যের খেল॥

যেদিন নেমে আসব তার দুদিন আগে তনুকা বল্‌লে,
“একটি জিনিষ দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা,—
একটি ফুলের গাছ।”
এ এক উৎপ৷ত। চুপ করে রইলেম।
তমুকা বল্‌লে, “দামী দুৰ্লভ গাছ,
এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।”
জিগেস করলেম, “নামটা কী?”
সে বল্‌লে “ক্যামেলিয়া।”
চমক লাগল -
আর একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।
হেসে বল্‌লেম, “ক্যামেলিয়া,
সহজে বুঝি এর মন মেলে না।”
তনুকা কী বুঝলে জানিনে হঠাৎ লজ্জা পেলে,
খুসিও হোলো।

চল্‌লেম টব সুদ্ধ গাছ নিয়ে।
দেখা গেল, পার্শ্ববর্ত্তিনী হিসাবে সহযাত্রিণীটি সহজ নয়।
একটা দো-কামরা গাড়িতে
টবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে।
থাক্‌ এই ভ্রমণবৃত্তান্ত,
বাদ দেওয়া যাক্ আরো মাস কয়েকের তুচ্ছতা।

পূজোর ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠল
সাঁওতাল পরগণায়।
জায়গাটা ছোটো। নাম বলতে চাইনে,—
বায়ু বদলের বায়ু-গ্রস্তদল এ জায়গার খবর জানে না।

কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র।
এইখানে বাসা বেঁধেচেন
শালবনের ছায়ায়, কাঠবিড়ালীদের পাড়ায়।
সেখানে নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে,
অদুরে জলধারা চলেচে বালির মধ্যে দিয়ে,—
পলাশবনে তসরের গুটি ধরেচে,
মহিষ চরচে হর্ত্তকি গাছের তলায়,—
উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে।
বাসা বাড়ি কোথাও নেই,—
তাই তাঁবু পাতলেম নদীর ধারে।
সঙ্গী ছিল না কেউ
কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া।



কমলা এসেচে মাকে নিয়ে।
রোদ ওঠবার আগে
হিমে-ছোঁওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায়
শাল বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি-হাতে।
মেঠো ফুলগুলো পায়ে এসে মাথা কোটে,—
কিন্তু সে কি চেয়ে দেখে।
অল্পজল নদী পায়ে হেঁটে
পেরিয়ে যায় ওপারে,
সেখানে সিসু গাছের তলায় বই পড়ে।
আর আমাকে সে যে চিনেচে
তা জানলেম আমাকে লক্ষ্য করে না বলেই

একদিন দেখি, নদীর ধারে বালির উপর চড়িভাতি করচে এরা।
ইচ্ছে হোলো গিয়ে বলি, আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই।
আমি পারি জল তুলে আনতে নদী থেকে-
পারি বন থেকে কাঠ আনতে কেটে,
আর তা ছাড়া কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে
একটা ভদ্রগোছের ভালুকও কি মেলে না।


দেখলেম দলের মধ্যে একজন যুবক,—
শর্ট-পরা, গায়ে রেশমের বিলিতি জামা,—
কমলার পাশে পা ছড়িয়ে
হাভানা চুরট খাচ্চে।
আর কমলা অন্যমনে টুকরো টুকরো করচে
একটা শ্বেতজবার পাপড়ি।
পাশে পড়ে আছে
বিলিতি মাসিক পত্র।


মুহূর্ত্তে বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগণার নির্জ্জন কোণে
আমি অসহ্য অতিরিক্ত, – ধরবে না কোথাও।
তখনি চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ।
আর দিন কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটবে,
পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি।
সমস্তদিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে,
সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল
আর দেখি কুঁড়ি এগোলো কত দূর।

সময় হয়েচে আজ।
যে আনে আমার রান্নার কাঠ
ডেকেচি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে।
তার হাত দিয়ে পাঠাব
শালপাতার পাত্রে।
তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়চি ডিটেক্‌টিভ গল্প।
বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, “বাবু ডেকেছিস্ কেনে
বেরিয়ে এসে দেখি, ক্যামেলিয়া
সাঁওতাল মেয়ের কানে,
কালো গালের উপর আলো করেচে।
সে আবার জিগেস করলে, “ডেকেচিস কেনে?”
আমি বল্‌লেম, “এই জন্যেই।”
তারপরে ফিরে এলেম কলকাতায়।

২৭ শ্রাবণ, ১৩৩৯