পুনশ্চ/ছেলেটা

উইকিসংকলন থেকে

ছেলেটা

ছেলেটার বয়স হবে বছর দশেক,—
পরের ঘরে মানুষ হয়েছে,
যেমন আগাছা বেড়ে ওঠে ভাঙা বেড়ার ধারে;—
মালীর যত্ন নেই,
আছে আলোক বাতাস বৃষ্টি
পোকামাকড় ধূলোবালি,
কখনো ছাগলে দেয় মুড়িয়ে
কখনো মাড়িয়ে দেয় গোরুতে,
তবু মরতে চায় না, শক্ত হয়ে ওঠে,
ডাঁটা হয় মোটা,
পাতা হয় চিকণ সবুজ।

ছেলেটা কুল পাড়তে গিয়ে গাছের থেকে পড়ে,
হাড় ভাঙে,
বুনো বিষফল খেয়ে ওর ভীর্ম্মি লাগে,
রথ দেখতে গিয়ে কোথায় যেতে কোথায় যায়,
কিছুতেই কিছু হয় না,—
আধমরা হয়েও বেঁচে ওঠে,
হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসে
কাদা মেখে কাপড় ছিড়ে;—
মার খায় দমাদম,
গাল খায় অজস্র,—
ছাড়া পেলেই আবার দেয় দৌড়।

মরা নদীর বাঁকে দাম জমেচে বিস্তর,
বক দাঁড়িয়ে থাকে ধারে,
দাঁড়কাক বসেচে বৈঁচিগাছের ডালে,
আকাশে উড়ে বেড়ায় শঙ্খ চিল, -
বড়ো বড়ো বাঁশ পুঁতে জাল পেতেচে জেলে,
বাঁশের ডগায় বসে আছে মাছরাঙা,
পাতিহাঁস ডুবে ডুবে গুগলি তোলে।
বেলা দুপুর।
লোভ হয় জলের ঝিলিমিলি দেখে,
তলায় পাতা ছড়িয়ে শ্যাওলাগুলো দুলতে থাকে,
মাছগুলো খেলা করে।
আরো তলায় আছে নাকি নাগকন্যা?
সোনার কাঁকই দিয়ে আঁচড়ায় লম্বা চুল,
আঁকাবাঁকা ছায়া তার জলের ঢেউয়ে।

ছেলেটার খেয়াল গেল ঐখানে ডুব দিতে,
ঐ সবুজ স্বচ্ছ জল,
সাপের চিকন দেহের মতো।
কী আছে দেখিই না, সব তাতে এই তার লোভ।
দিল ডুব, দামে গেল জড়িয়ে-
চেঁচিয়ে উঠে খাবি খেয়ে তলিয়ে গেল কোথায়।
ডাঙায় রাখাল চরাচ্ছিল গোরু,
জেলেদের ডিঙি নিয়ে টানাটানি করে তুললে তাকে,
তখন সে নিঃসাড়।
তারপরে অনেকদিন ধরে মনে পড়েচে
চোখে কী করে শর্ষেফুল দেখে,
আঁধার হয়ে আসে,
যে মাকে কচিবেলায় হারিয়েচে
তার ছবি জাগে মনে,
জ্ঞান যায় মিলিয়ে।
ভারি মজা,
কী করে মরে সেই মস্ত কথাটা।
সাথীকে লোভ দেখিয়ে বলে,—
“একবার দেখনা ডুবে, কোমরে দড়ি বোঁধে,
আবার তুলব টেনে।”
ভারী ইচ্ছা করে জানতে ওর কেমন লাগে।
সাথী রাজি হয় না,
ও রেগে বলে, “ভীতু, ভীতু, ভীতু কোথাকার।”

বক্সিদের ফলের বাগান, সেখানে লুকিয়ে যায় জন্তুর মতো।
মার খেয়েচে বিস্তর, জাম খেয়েচে আরো অনেক বেশি।

বাড়ির লোকে বলে, লজ্জা করে না বাদর?
কেন লজ্জা?
বক্সিদের খোঁড়া ছেলে তো ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে ফল পাড়ে,
ঝুড়ি ভরে নিয়ে যায়,—
গাছের ডাল যায় ভেঙে,
ফল যায় দলে',
লজ্জা করে না?

একদিন পাকড়াশিদের মেজোছেলে একটা কাঁচ-পরানো চোঙ নিয়ে
ওকে বল্‌লে, দেখনা ভিতর বাগে।
দেখল নানারঙ সাজানো,
নাড়া দিলেই নতুন হয়ে ওঠে।
বল্‌লে, “দে না ভাই, আমাকে।
তোকে দেব আমার ঘষা ঝিনুক,
কাঁচা আম ছাড়াবি মজা করে,
আর দেব আমের কষির বাঁশি॥”

দিল না ওকে।
কাজেই চুরি করে আন্‌তে হোলো।
ওর লোভ নেই,
ও কিছু রাখতে চায় না, শুধু দেখতে চায়
কী আছে ভিতরে।
খোদন দাদা কানে মোচড় দিতে দিতে বললে,
“চুরি করলি কেন।”
লক্ষ্মীছাড়াটা জবাব করলে,
“ও কেন দিল না।”
যেন চুরির আসল দায় পাকড়াশিদের ছেলের।

ভয় নেই ঘৃণা নেই ওর দেহটাতে।
কোলা ব্যাঙ তুলে ধরে খপ করে,
বাগানে আছে খোঁটাপোঁতার এক গর্ত্ত,
তার মধ্যে সেটা পোষে, —
পোকামাকড় দেয় খেতে।
গুবরে পোকা কাগজের বাক্সোয় এনে রাখে,
খেতে দেয় গোবরের গুটি,
কেউ ফেলে দিতে গেলে অনর্থ বাধে।
ইস্কুলে যায় পকেটে নিয়ে কাঠবিড়ালী।
একদিন একটা হেলে সাপ রাখলে মাষ্টারের ডেস্কে,—
ভাব্‌লে, দেখিই না, কী করে মাষ্টার মশায়।
ডেক্‌সো খুলেই ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠে দিলেন দৌড়-
দেখবার মতো দৌড়টা।

একটা কুকুর ছিল ওর পোষা,
কুলীনজাতের নয়,
একেবারে বঙ্গজ।
চেহারা প্রায় মনিবেরই মতো,
ব্যবহারটাও।
অন্ন জুটত না সব সময়ে
গতি ছিল না চুরি ছাড়া,
সেই অপকর্ম্মের মুখে তার চতুর্থ পা হয়েছিল খোঁড়া।
আর সেই সঙ্গেই কোন্ কার্য্যকারণের যোগে
শাসনকর্ত্তাদের শসাক্ষেতের বেড়া গিয়েছিল ভেঙে।
মনিবের বিছানা ছাড়া কুকুরটার ঘুম হোতো না রাতে,
তাকে নইলে মনিবেরও সেই দশা।

একদিন প্রতিবেশীর বাড়া ভাতে মুখ দিতে গিয়ে
তার দেহান্তর ঘটল।
মরণান্তিক দুঃখেও কোনোদিন জল বেরোয়নি যে ছেলের চোখে
দুদিন সে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে কেঁদে বেড়ালো,
মুখে অন্ন জল রুচল না,
বক্সিদের বাগানে পেকেচে করমচা,
চুরি করতে উৎসাহ হোলো না।
সেই প্রতিবেশীদের ভাগনে ছিল সাত বছরের,
তার মাথার উপর চাপিয়ে দিয়ে এল এক ভাঙা হাঁড়ি।
হাঁড়ি-চাপা তার কান্না শোনালো যেন ঘানিকলের বাঁশি।


গেবস্ত-ঘরে ঢুকলেই সবাই তাকে দূর দূর করে,
কেবল তাকে ডেকে এনে দুধ খাওয়ায় সিধু গয়লানি।
তার ছেলেটি মরে গেছে সাতবছর হোলো,
বয়সে ওর সঙ্গে তিন দিনের তফাৎ।
ওরই মতো কালো কোলো,
নাকটা ঐ রকম চ্যাপটা।
ছেলেটার নতুন নতুন দৌরাত্মি এই গয়লানি মাসির পরে,
তার বাঁধা গোরুর দড়ি দেয় কেটে,
তার ভাঁড় রাখে লুকিয়ে,
খয়েরের রং লাগিয়ে দেয় তার কাপড়ে।
দেখি না কী হয়, তারই বিবিধ রকম পরীক্ষা।
তার উপদ্রবে গয়লানির স্নেহ ওঠে ঢেউ খেলিয়ে।
তার হয়ে কেউ শাসন করতে এলে
সে পক্ষ নেয় ঐ ছেলেটারই।

অম্বিকে মাষ্টার আমার কাছে দুঃখ করে গেল—
“শিশুপাঠে আপনার লেখা কবিতাগুলো
পড়তে ওর মন লাগে না কিছুতেই,
এমন নিরেট বুদ্ধি।
পাতাগুলো দুষ্টুমি করে কেটে রেখে দেয়,
বলে ইদুরে কেটেচে।
এত বড়ো বাঁদর।”
আমি বল্লুম, “সে ত্রুটি আমারই,
থাকত ওর নিজের জগতের কবি,
তাহলে গুবরে পোক। এত স্পষ্ট হোত তার ছন্দে
ও ছাড়তে পারত না।
কোনোদিন ব্যাঙের খাঁটি কথাটি কি পেবেচি লিখতে,
আর সেই নেড়ী কুকুরের ট্র্যাজেডি।”

২৮ শ্রাবণ ১৩৩৯