পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/জীরালনী

উইকিসংকলন থেকে

জিরালনী

 জিরালিনীর পালাটি অসম্পূর্ণ। এই গানটি শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দে মহাশয় পীরসোহাগপুর গ্রামের রজনী কর্ম্মকার ও ভাদাই ফকির নামক বাউল-গায়কের নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়াছেন। পীরসোহাগপুর গ্রামটি মৈমনসিংহের অন্তৰ্গত।

 এই গানটি কতকটা রূপকথার মত। আমরা শৈশবে রাজপুত্ত্রদের মাথায় কবচ বান্ধিয়া তাহাদিগকে পশু করিয়া রাখিবার অনেক গল্প শুনিয়াছি। কামরূপের মেয়েরা নাকি এই সব যাদুকরী বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এই পালাটিতে রাজপুত্ত্রকে তাঁহার বিমাতা চুলের সঙ্গে ঔষধ বাঁধিয়া হরিণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। দৈবাৎ ইনি রাজকুমারী জিরালনীর হাতে যাইয়া পড়েন এবং রাজকুমারীর যত্নে তিনি তাঁহার একান্ত বশীভুত হন। এই অবস্থায় একদা তাঁহার চুলের মধ্যে, কবচ ধরা পড়ে। কবচ উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমার স্বীয় স্বাভাবিক অবয়ব প্রাপ্ত হন। জিরালিনীর সঙ্গে তাঁহার গন্ধর্ব্বমতে বিবাহ হইয়া যায়। রাজপুত্ত্র দিনে স্বর্ণবর্ণ হরিণ হইয়া বেড়াইতেন এবং রাত্রিতে মানুষ হইয়া রাজকুমারীর সঙ্গে প্রেমাভিনয় করিতেন। কিন্তু একদিন কবচটি হারাইয়া যাওয়াতে তাঁহার আর মৃগ হইবার উপায় বন্ধ হইয়া যায়। তখন উপায়ান্তর না দেখিয়া তিনি সাশ্রুনেত্রে রাজকুমারীর নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া সে দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যান। ওদিকে জিরালনীর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা দুলাই তাহাকে বিবাহ করিবার জন্য ক্ষিপ্তপ্রায় হয়। বৈমাত্রেয় ভাইকে বিবাহ করা যায় কিনা রাজা তাঁহার সভাপণ্ডিতদের নিকট এই প্রশ্ন উত্থাপিত করেন। তাঁহারা তৈলবটের লোভে শিরঃসঞ্চালনপূর্ব্বক রাজার ইচ্ছার অনুকূল মত প্রদান করেন। ঘোর বিপদে পড়িয়া জিয়ালিনী নদীগর্ভে নিপতিত হন এবং দৈবক্রমে এক জেলের জালে আবদ্ধ হইয়া মৃত্যু হইতে উদ্ধার পান। ইহার পরে এক ধনবান্ সাধু জেলের নিকট হইতে তাহাকে উদ্ধার করেন। রাজকুমারীর ইচ্ছানুসারে কোন্ রাজপুত্ত্র একদা হরিণ হইয়াছিলেন এই সংবাদ জানিবার জন্য সাধু চৌদ্দ ডিঙা সাজাইয়া দেশদেশান্তর পর্য্যটন করিতে রওনা হন। অতল সমুদ্রে চৌদ্দ ডিঙা ঝড়ে পড়িয়া ডুবিয়া যায়। পালা এইখানেই সাঙ্গ হইয়াছে। আমার মনে হয় পালাটি খুব দীর্ঘ ছিল। চন্দ্রকুমারবাবু ইহার অধিক আর সংগ্রহ করিতে পারেন নাই। কতকটা রূপকথার মত হইলেও এই গানটি পল্লীরসমাধুর্য্যে ভরপুর। জলে ডুবিতে ডুবিতে রাজকন্যা তাঁহার পিতা-বিমাতার উদেশে যে সকল কথা বলিয়াছিলেন তাহা বড়ই করুণ। রাজকুমার দুলাই-নির্ম্মিত উদ্যান বাটিকায় যে সকল ফুলের বর্ণনা আছে তাহা আমাদের চোখে বাঙ্গালার পল্লীমহিমা উদঘাটিত করিয়া দেখায়। সর্ব্বত্রই একটা করুণরসের প্রবাহ পাওয়া যায় এবং এই খণ্ডিত গানের মাধুর্য্য আমাদের চিত্ত আকর্ষণ করে। চৌদ্দ ডিঙা জলে ডুবিবার পর পাঠকের মনে কবি যে কৌতূহল জাগ্রৎ করিয়া দিয়াছিলেন তাহা পূর্ণ হয় নাই। কিন্তু জিরালনীর চরিত্র যে আদ্যন্ত একনিষ্ঠ, প্রেমসঙ্কল্পিত, তাহা পালাটির যতটুকু পাইয়াছি তাহাতেই আমরা বুঝিয়াছি। কালে যদি কেহ এই পালাটি সম্পূর্ণ করিতে পারেন তবে আমরা সুখী হইব। এই গানটির ভাষা ও পয়ার ছন্দের সুগঠিত অবয়ব দেখিয়া আমাদের মনে হয় ইহা অষ্টাদশ শতাব্দীর রচনা। অপেক্ষাকৃত আধুনিক হইলেও ইহাতে প্রাচীন যুগের সংস্কারের প্রভাব বহুল পরিমাণে আছে। যে আকারে আমরা ইহা পাইতেছি তাহা অপেক্ষাকৃত আধুনিক, এই পর্য্যন্ত আমরা বলিতে পারি। এই খণ্ডিত পালাটিতে ৫১০ ছত্র আছে। আমরা ইহা ১৩ অধ্যায়ে ভাগ করিয়াছি।

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন

জীরালনী

জীরালনী

(১)

কুশাই নদীর উত্তরি ময়াল ভাইরে নয়া গঞ্জের হাট।
ভাইরে নয়া গঞ্জের হাট।
গঞ্জের রাজা চক্রধর, গুণ কহি তার ঠাট[১]
বড়ই ক্ষেমতা রাজার চৌঘুরি বিস্তর।
কুশাই নদীর পাড় জুড়িয়া তান নয়া নয়া ঘর॥
আরে ঘর পারে ঘর দখিনা দুয়ারি।
স্বপনের কথারে যেমুন মধুমল্লার পুরী[২]
বায়ান্ন দুয়ারী ঘর আবে ঝিলিমিলি।
সদরে কাছারে করেন রাজা ঠাকুরালী॥
পুব পাহাড়ের শালধা কাঠে বড়া বড়া ঠুনি
ও ভাই বড়া বড়া ঠুনি।
রাজ্যের যত মাছুয়ারাঙ্গা মারিয়া দিছে ছানি॥
দূরন বাক্যা নজর করলে বাইরা মালুম হয়।
মেঘের উপরে যেমুন রামধনুর উদয়॥
হাতী ঘোড়া আছে রাজার দাওদা সুবিস্তার।
একদিন গেলাইন রাজা হরিণা শীকারে।(১–১৬)

(২)

বেবান জঙ্গলারে ভাই কূল নাই নাইসে কিনারা।
লোক লস্করে থইয়া না রাজা ছুডাইলাইন ঘোড়া॥
অতিশ বেগানন ঘোড়ার গায়ে আইল ঘাম॥
ঘোড়ার পিঠে থাইক্যে রাজা মালুম কইরা চায়।
সোণার বন্ন হরিণ গোটা[৩] সামনে দেখা যায়॥
(হায়) দেখে রাজা চলে হরিণ ভালা সোনা দিয়া জোড়া। 
শিঙ্গার হইয়াছে বহুত দুই কর্ন্ন খাড়া॥

এরে দেখে রাজা তবে ঘোড়া ছুটাইল।
ছুটিতে ছুটিতে ঘোড়া জঙ্গলে পড়িল॥
জঙ্গল ছাড়িয়া ঘোড়া ময়দানে চল্যা যায়।
সোণার বন্ন হরিণ দেখ আগু আগু যায়॥
রাজার লস্কর দেখ চাইর দিক্ বেড়িল।
বেড়িয়া না চাইর দিক্ হরিণ ধরিল।
কেউ বলে মার মার কেউ বলে নাই।
ইহারে লইয়া চল রাজ্যপুরে যাই॥

তবে রাজা চক্রধর ভালা কোন্ কাম করে।
সোণার না হরিণ লইয়া গেল নিজপুরে॥(১—১৭)

(৩)

শুন শুন পরাণ কন্যা কহিযে তোমারে।
হরিণ আন্যাছি এক তোমার লাগিয়া॥
সোণার বরণ হরিণরে রূপার বরণ আঁখি।
লালবরণ রক্তশিঙ্গা কখনও না দেখি।

ডুরি লাগাইয়া হরিণ বান্ধিয়া রাখিল।
কতদিনে হরিণ তবে কন্যার পোষনিয়া হইল॥
খাওয়ায় নাওয়ায় কন্যা মনের মতন।
বনের হরিণে কন্যা করয়ে যতন॥

একদিন হইল কিবা শুন দিয়া মন।
হরিণে করয়ে ছিনান কন্যা করিয়া যতন॥
শিঙ্গের মাঝেরে কন্যা নিউলিয়া[৪] চায়।
সোণার কবচ বান্ধা তাহে দেখতে পায়॥
আচানক দেইখ্যা কন্যা কোন্ কাম করে।
কবচ খুলিয়া কন্যা লইল আপন হাতে॥
হাতেত লইয়া কবচ কন্যা যখন চাইল।
সোণার বন্ন হরিণ দেখ কুমার হইল৷
সুন্দর কুমার হায় পথম যৌবন।
এমুন সুন্দর রূপ না দেখি কখন॥
চান্দ যেমুন নামিয়েছে আসমান ছাড়িয়া।
মোহিত হইল কন্যা কুমারে দেখিয়া॥

কুমার কয় কন্যালো তুমি কি কাম করিলা।
শীঘ্র কইরা শিরের কবচ শিরেতে বান্ধহ॥
লোকজনে দেখলে কন্যা হইবে বিপদ্॥
আচমকা রাজকন্যা কোন্ কাম করিল।
কুমারের কেশমধ্যে কবচ বান্ধিল॥
যেই সে হরিণ ছিল সেইমত হইল।
ভাগ্যগুণে রাজার ঝি লো কেহ না দেখিল॥(১—২১)

(8)

পরথম যৌবন লো কন্যা পরথম বয়সে।
মেঘমতী নাম কন্যা চন্দ্র যেমুন হাসে॥
কি কব কন্যার রূপ কইতে না জোয়ায়।
যেই জন দেখে কন্যা করে হায় হায়॥
মেঘমতী নাম কন্যা মেঘের বরণ চুল।
মুখখানি দেখি কন্যার চন্দ্র সমতুল॥
সেজুতিয়া[৫] তারা যেমুন জ্বলে দুই আঁখি।
রাঙ্গা রাঙ্গা দুই ঠোঁট সিন্দুরেতে মাখি।
হাসিলে কৌতুকে কন্যা পুরী সে উজলা।
গলায় শোভিছে কন্যার হীরা ফুলের মালা॥
পিন্ধনে পইরাছে কন্যা অগ্নি পাটের শাড়ী।
মাথার কেশ বাইন্ধাছে কন্যা নিয়া মুক্তাদড়ি।
নিছ্যা মুছ্যা লয় মায় চন্দ্রমুখ খানি॥
আদর কর‍্যা ডাকত মায় কন্যা জীরালনী॥
সেইত দুঃখিনী মাও গেছে বনবাসে।
এই দুঃখ পায় কন্যা পরথম বয়সে॥
সে সব বহুত কথা এই খানে রহিল।
রাত্রিকালে দেখ কন্যা কোন্ কাম করিল॥

জোড় মন্দির ঘর কন্যা একেলা শুইয়া।
সোণার পালঙ্কে রাখে হরিণ বান্ধিয়া॥
এক পর রাত্রি গেল কন্যার হায় যে হুতাশে।
দুই পর রাত্রিকালে কন্যা পালঙ্কেতে বইসে॥
তিন পর রাত্রিকালে কন্যা ভাবিয়া চিন্তিয়া।
শিঙ্গা হইতে লইল কন্যা কবচ খুলিয়া॥

চান্দ সমান রাজার পুত্র সামনেতে খাড়া।
ঘুমায় রাজ্য না বাসী না জানে সে তারা॥

কোথায় আইলাম সুন্দর কন্যালো কিবান দেশের নাম।
দুঃখের না হাতে কন্যা করিলে আছান[৬]
কিবা তোমার বাপ মাও কি নাম তোমার।
পরিচয় কথা কন্যা কহ একবার॥
কন্যা কহে শুন শুন কুমার সুন্দর।
গঞ্জের হাটে বসে রাজা নাম চক্রধর॥
তার কন্যা আমি রে কুমার নাম মেঘমতী।
সোহাগে রাখিল মোরে নাম জীরালনী॥
কোথায় তোমার বাড়ীরে ঘর কেবা বাপমাও।
সুন্দর কুমার মোরে জানাইয়া যাও॥

এই কথা শুনিয়া কুমার কান্দিতে লাগিল।
পালঙ্কে বসিয়া কুমার কহিতে লাগিল॥
দণ্ডপুরে বাস করি রাজা দণ্ডপতি।
তাঁর পুত্র হই আমি শুন মেঘমতি॥
বিমাতা কুচক্রী হইয়া পাঠায় বনবাসে।
রাজারে কইরাছে রাণী আপনার বশে॥
বহুরা বেইমান বুড়ী মায়ের চাইয়া।
সতাইরে বনের ওষুধ দিল সে আনিয়া॥
অত নাই সে জানিলো কন্যা তত নাই সে জানি।
সতাই দেখিত মোরে তার পরাণ মণি॥
একদিনের কথা কন্যা এই মনে হয়।
বিভুলা নিদ্রায় দেহা হইলা অবশ॥

পরেত হইলা কিবা কিছুই না জানি।
বনেত পরবেশ করি হইয়া বনের প্রাণী॥

বাঘ ভালুকের হাতে কন্যা কখন পরাণ যায়।
শিকারী জনের হাতে কন্যা কে রাখে আমায়॥
বার বছর যায় কন্যা কান্দিয়া কান্দিয়া।
এই খানে আনিল কন্যা তোমার বাপেত বান্ধিয়া॥
এই কথা শুনিয়া কন্যার আঁখ্‌খি জারে জার।
কন্যা কহে দুঃখের কথা শুনহে আমার॥
কঠিন নিঠুর বাপ পাষাণ হইল।
আমার মায়েরে দেখ বনবাসে না দিল॥
আমার সতাইর দেখ মুখে মধুর হাসি।
কুচক্র করিয়া মায় করলো বনবাসী

আমার দুঃখিনী মাও কই সে জানি আছে।
রাজ্যসুখ ছাইড়া বনে যাইতাম তার কাছে॥
আর এক কথা শুন দুঃখের বিবারণ।
বিমাতার পুত্র ভাই আছে একজন॥
দুরন্ত দুলাই ভাই মোরে করব বিয়া।
মনে মনে এই কথা রাখিছে ভাড়াইয়া॥
বিষ খাইতাম নহেরে গলে দিতাম দড়ি।
সাথী সঙ্গ পাইলে যাইতাম বাপের রাজ্য ছাড়ি॥

ডুকরিয়া কান্দে কন্যা জোড় মন্দির ঘরে।
কুমার কহে শুন শুন কন্যা কহি যে তোমারে॥
এক সুতে বাইন্ধাছে বিধি তোমারে আমারে।
যত দুষ্ক পাইয়াছি দেখ মা বাপের হাতে॥
সে সব দুষ্কের কথা কইতে না ফুরায়।
তোমারে ছাড়িয়া যাইতে আমার মন নাই সে চায়॥

হরিণ হইয়া থাকি কন্যা তোমার মন্দিরে।
পরথম যৌবন কন্যা বিয়া কর মোরে।
দেখিয়া তোমার রূপ মজিয়াছে আঁখি।
এমুন সুন্দর রূপ কভু নাই সে দেখি॥
সুযোগ পাইলে কন্যালো যাইব পলাইয়া।
এইখানে করি বাস তোমারে লইয়া॥
তোমার মায়েরে কন্যা খুঁজিয়া লইব।
তারপর নিজ রাজ্য উদ্ধার করিব॥
তোমারে করিব লো কন্যা রাজপাটরাণী।
তোমারে করিব কন্যা আমার মাথার মণি॥

ভুলিল রাজার কন্যা পরথম যৌবন।
কুমারের হাতে কন্যা সপে দেহ মন॥
এই মত আছে ক্যা আপন বাপের ঘরে।
রাজ্যবাসী লোক যত এতেক না জানে॥(১—৮৮)

(৫)

খাওয়ায় ধুয়ায় কন্যা পালয় হরিণ।
ভিতরে গুমুর[৭] কথা কেহুর না জানা॥
দিনেত হরিণ সেই রাত্তি সে কুমার।
এই মতে যায় দিন সুখে দুই জনার॥
একদিন ভোলা কন্যা কোন্ কাম করিল।
সোণার কবচ দেখ খুলিয়া না লইল॥
রাত্রি না দুপুর কালে পালঙ্কে শুইয়া।
দুই জনে কহে কথা নিরলে থাকিয়া॥

নিতি নিতি কবচ কন্যা কেশে রাখে বান্ধিয়া।
আজিকার কবচ কন্যা ফালায় হারাইয়া॥
ঘুমতনে জাগিয়া কন্যা দেখে ভোর রাতি।
কন্যা কহে উঠ উঠ পরাণের পতি॥
উঠ উঠ পরাণ প্রভো চক্ষু মেলি চাও।
গাছেতে কোকিলা ডাকে রজনী পোহায়॥
জাগিল সুন্দর কুমার প্রভাতের কালে।
কবচ ধরিতে কন্যা বান্ধা কেশ খুলে
সারা কেশ বিলি বিলি কবচ নাইসে পায়।
মাথায় হাত দিয়। কন্যা করে হায় হায়॥
কি হইব উপায় কন্যা কি হইব হায়।
কোন দৈব বাদী হইল কি করি উপায়॥

বিমাতা রাক্ষসী কিবান জানিতে পারিল।
গোপন করিয়া কবচ চুরি করিয়া নিল॥
খাটেত পড়িল কিবা নিশিরাত্র দায়।
উলটি পালটি কন্যা কবচ বিচরায়॥
কুমার কহে কন্যা হিতে বিপরীত।
বিপদ্ বাড়িল কন্যা বুঝহ নিশ্চিত॥
তোমার কলঙ্ক কন্যা আমি যাব শূলে।
আজি দিবা কন্যা তুমি রাখ মোরে ছলে॥
দাসীগণে ডাক কন্যা ঘুমে অচেতন।
খোলহ মন্দির দুয়ার তুরন্ত গমন।
শিখান বালিশে কন্যা বিছান ঢাকিয়া।
এহি মতে কুমার তবে রাখে লুকাইয়া॥

কন্যা কহে ধাইলো মোর গায়ে আইল জ্বর।
ছিনানের কার্য্য নাই তোমরা যাও নিজ ঘর॥

না করিব ছান লো ধাই, না খাইব অন্ন।
দারুণ জ্বরেতে মোর অঙ্গ ছিন্ন ভিন্ন॥
চক্ষু দুটি হইল মোর রক্তের আকার।
মাথার বিষে মরি লো ধাই দেখি অন্ধকার॥
চল্যা গেল ধাই সব কন্যা রইলো পড়িয়া।
এই মতে গেল দিন শয্যা সামালিয়া॥

* * * *

রজনী দুপর কালে কন্যা ধীরে কথা কয়।
এই ভাবে থাকা কন্যা পরাণ সংশয়॥
বিদায় দেহ চন্দ্রমুখী কন্যালো বিদায় কর মোরে।
পরাণে বাঁচিলে দেখবা তোমার দুয়ারে॥
বনে বনে তল্লাস না করি দেখমু তোমার মায়।
প্রাণ থাকিলে হইব দেখা কহি যে তোমায়॥
বিদায় লইয়া রাজার পুত্র পন্থে মেলা দিল[৮]
কন্যার চক্ষের পানি পালঙ্গ ভাসিল॥
কান্দে মেঘমতী কন্যা ভূমে লুটাইয়া।
ভিনদেশী নাগর সনে হইল গোপন বিয়া॥
বিধাতার নির্ব্বন্ধ কথা খণ্ডন না যায়।
দিবসে দেখিয়া স্বপন যেন হায়(১—৫২)

(৬)

হেথায় রাজার পুত্র নাগর দুলাই।
রাত্র দিবা ভাবে কন্যা অন্য চিন্তা নাই॥
আহা কন্যা জীয়ালনী কেমনে পাইব।
জীরা বিনা পরাণ মোর কেমুনে রাখিব॥

রাজ্য বেরথা ধন বেরথা মনের মানুষ না পাই।
কি করিব মাও বাপ অন্য নাই সে চাই॥
যত যত রাজকন্যা বাপে সম্বন্ধে সে আনি।
নাগর দুলাই কহে বিয়া না করিবাম আমি॥
হায় বিধাতা দুষ্মন হইয়া হইল প্রতিবাদী।
জীরালনী কন্যা বুইন না হইত যুদি॥
আমার পরাণ জীরা নয়নের কাজলী।
হেন জীরায় ভইন করিয়া ভাগ্য দিল গালি॥

ভাব্য। চিন্তা রাজপুত্র কোন্ কাম সে করে।
বাগান রচিল এক গড়ের ভিতরে॥
ভালা করিয়া পরিপাটী লাগাইল চারা।
চাইর দিকে দিয়া খুটি জীগায় দিল বেড়া॥
মাঝে মাঝে লাগাইল নানা জাতি ফুল।
ফুটিল সোণার চাম্পা গন্ধেতে আকুল॥
মালতী মল্লিকা কত লেখাজোখা নাই।
টগর যুথী লাগাইল নাগর দুলাই॥
সূর্য্যমুখী ফুল ফুটে সূর্য্যমুখ চাইয়া।
ফুল ফুটে স্থলপদ্ম রাঙ্গা জবা ধিয়া॥
হীরা জীরা ফুটে ফুল নইক্ষত্র আকৃতি।
সপ্পফনা ফুল ফুটে সপ্পের আকৃতি॥
ধনুকা কাটালী চাম্পা, চাঁপা নানা জাতি।
এমতে ফুটয়ে ফুল নাহি দিবা রাতি॥

ফুলের বাহার দেখ্যা কন্যা জিরালনী।
ধায়ের কাছে কয় কন্যা না দেখি না শুনি॥
শুনলো নাগরী ধাই কহি যে তোমারে।
রাজার পুত্র করে বাগান দেখছনি তাহারে॥

ধাই কহে শুন কন্যা আশ্চর্য্য ঘটন।
এমুন ফুলের রাজ্য না দেখি কখন॥
এক ডালে লক্ষ চাম্পা রইয়াছে ফুটিয়া।
আসমানের তারা যেমুন রাখ্যাছে বান্ধিয়া॥
বসন্ত রাখ্যাছে বান্ধিয়া কুমার বাগানে।
চল কন্যা যাইবানি বাগান দরিশনে॥
ভাইয়ের লাগাইল বাগান ভইনে নাইসে দেখে।
একবার সার্থক জন্ম নিজ নয়নে দেখে॥

সুবুদ্ধি রাজার মাইয়ার কুবুদ্ধি যে হইল।
আস্তে ব্যস্তে ধাইয়ের সঙ্গে পন্থে মেলা দিল॥
দুপুরিয়া দিনের বেলা কেউ নাই যে কোথা।
জিরালনী ধাইয়ের সঙ্গে উপনীত তথা॥
দেখিয়া বাগান কন্যা নয়ান জুরায়।
সার্থক করিয়া ভাই যে বাগিচা বানায়॥
কত ফুল চিনি বা কতক নাহি চিনি।
একে একে দেখে ফুল কন্যা জিরালনী॥
বসন্ত হাওয়ায় কন্যার দীর্ঘ কেশ উড়ে।
একে একে যায় কন্যা সকল খান ঘুরে॥
দুপুর হইল গত হাল্যা পড়ে রবি।
ছানের বেলা যায় কন্যা চল শীঘ্র করি॥
চমকিয়া কন্যা তবে কোন্ কাম করিল।
ধাইয়ের সঙ্গতি কন্যা মন্দিরে সামাইল॥
দৈবের নির্ব্বন্ধ কথা কে খণ্ডাইতে পারে।
এক গাছি কেশ ছিইড়া রইল পুষ্প ডালে॥(১—৫২)

(৭)

কাম কর মালী আরে আমার বাগানে।
এক কথা মালী আরে সুধাই তোমারে॥

বাগানের পথে দেখি পায়ের দাগ পড়ে।
কোন্ জনে আইল মোর পুষ্প লইবারে॥
সর্ব্ব ফুল দেখে দুলাই নেহালি নেহালি।
কেহ নাই সে ছুইয়াছে তার কুসুমের কলি॥

মালী কহে ধর্ম্মরাজ যেখানে যা ছিল।
নড়চর কারো কিছু কভু না হইল॥
কেবা আইল কেবা গেল কিছু নাইসে দেখি।
বাগানের পুষ্পলতা আছে তার সাক্ষী॥
বনেত কুকিল। ডাকে ঘন ঘন বায়।
দেখয়ে কুমার এক কেশ উড়ি যায়॥
থাপা দিয়া ধরে কুমার মুইঠে লইল কেশ।
জোড়মন্দির ঘরে গিয়া করিল পরবেশ॥

দুর্জ্জন রাজার বেটা ফন্দি করে ভারি।
সোণার কবাটে দিল রূপার খিল ভরি॥
ধাই দাসী ডাকে কুমার ছানের বেলা যায়।
খিদায় কাতর পরাণী ডাকছে রাণী মায়॥
কবাট না ঘুচায় সে কুমার নাহি করে রাও।
শুনিয়া দৌড়িয়া আইল পাগলিনী মাও॥
মায় ডাকে ঘন ঘন কুমার উঠরে সকালে।
খিদা লইয়া মায়ের পুত্র থাকবে কত কালে॥
তবে আসিয়। রাজা জিজ্ঞাসয় পুতে।
উঠ পুত্র কিবান হইল কহ মোর থানে॥

আস্তে বস্তে কবাট খুলিয়া বাহির হইল।
মায়ের মন্দিরে গিয়া মাওকে দেখাইল॥
আজুকা বাগানে মাগো গেলা ভরমিতে।
আচানক চিজ এক দেখি আচম্বিতে॥

আমার হুকুম না লইয়া কে গেল বাগানে।
তাহার মাথার কেশ দেখ বিদ্যমানে॥
মানুষ হইব কিবা হইব দানা পরী।
এমন দীঘল কেশ কভু নাইসে দেখি॥
এই কেশ যার মাগো তারে করবাম বিয়া।
তা নইলে ত্যজিব পরাণ গলে কাতি দিয়া॥
না ছুইব অম্ল মাগো না পিইব পানি।
জোড়মন্দির ঘরে মাগো ত্যজিম পরাণী॥(১—৩৫)

(৮)

কান্দিয়া আকুলা রাণী রাজারে জানায়।
শুন্যা রাজা চন্দ্রধর করে হায় হায়॥
এমন যাহার কেশ কোথা পাইব তারে।
পাইয়া দুর্লভ পুত্র হারালাম তারে॥
এমন সুন্দর কন্যা পাইব কোথাকারে।
রাণী কহে এই কন্যা আছে তব ঘরে॥

শুনিয়া হইল রাজ। অতি চমৎকার।
চিন্তায় হইল মরা ভাবে আর বার॥
না দেখি না শুনি কভু অঘটন হেনে।
ভাই হইয়া বহিন বিয়া করিবে কেমনে॥
পাত্রমিত্র লইয়া রাজা যুক্তি যে করিল।
রাজ্যের পণ্ডিতগণ সব একত্রে করিল॥

তবেত পণ্ডিতগণ গণে যুকতি বাতলায়।
শুন রাজা এক কথা কহি যে তোমায়॥
পূর্ব্বে রাজা বীরসিংহ-ছত্র দেশপতি।
ভাই হইয়া ভগ্নী বিয়া করিল এমতি॥

ভাঙ্গুরায় রাজপুত্র মাণিক্য সে রায়।
মামাতু ভগ্নীরে বিয়া করিল সে দায়॥
আর যত হইল বিস্তার কথন।
এ বিয়ার দোষ নাই কহে গুরুজন॥
তুমি যদি অনুমতি দেহ রাজ্যপতি।
শাস্ত্র বলে দোষ নাই না হইব অগতি॥

এত শুন্যা রাজা তবে আনন্দিত মন।
বিয়ার লগ্ন দেখে রাজা বিচারিয়া ক্ষণ॥
শুন শুন মাও জীরা কহে পাটরাণী।
তোমার রূপের কথা জগতে বাখানি॥
গুরুজনের কথা মাগো না কর হেলন।
সুখেতে বঞ্চহ ঘরে না ভাইব দুষ্মন[৯]
তোমারে করিব মাগো রাজপাটেশ্বরী।
এত বলি কান্দে রাণী জীরার হাত ধরি॥
জীরা কহে শুন মাগো আমার এক কথা।
রাখিব বাপের কথা না হবে অন্যথা॥
বিয়ার উদ্যোগ কর রঙ্গ-পরিহাসে।
এতেক বলিয়া তবে জীরালনী হাসে॥(১—৩৪)

(৯)

দুই নয়ান ঝরে জলে রাণী নাইসে দেখে।
আপন মন্দিরে রাণী গেল নিজ সুখে॥
হেনকালে কন্যা জীরা কোন্ কাম করিল।
ছানের অছিলায় কন্যা গাঙ্গের ঘাটে গেল।
আষাঢ়িয়া পাগল নদী ঢেউয়ে কূলে পানি।
পাগল হইয়া কন্যা ধাইল একাকিনী॥

সোণার বাটায় গাইষ্ঠ খিলা যতনে বান্ধিয়া।
ধাই দাসী চলে সঙ্গে উলাস করিয়া॥
কেউ লইল গামছা আর কেউবা পাটের শাড়ী।
কেউ লইল গন্ধ তেল কেউ বা সন্নের ঝারি॥

আস্তে ব্যস্তে চলে তারা দড়বড়ি পথ।
ততক্ষণে গেল জীরা নয়া গাঙ্গের ঘাট॥
মনের বাহার পানসী বৈঠা পবন কাটে।
সেই নাও পাইয়। কন্যা পারা দিল ঘাটে॥
ভাসিল মনের[১০] নাও জলের উপরে।
আউলা দীঘল কেশ ডেউয়ে নাইসে ধরে॥
আছাড় খাইয়া পানি নাও ভাসাইল।
উতালা তুরুঙ্গ[১১] ঢেউ পাগল হইল॥
সন্নের পরতিমা খানি ঢেউয়ে ভাইস্যা যায়।
এরে দেখ্যা ধাই দাসী করে হায় হায়॥
ধাই দাসী ডাক্যা কয় কন্যা পাড়েত উত্তর।
কি দিব উত্তর মায়ে যদি না যাও ঘর॥
মাঝ নদীতে থাক্যা কন্যা ডেউয়ে মারে বাড়ি।
জলের উপরে কন্যা ভাসে একেশ্বরী॥

শুন শুন ধাই দাসী তোমরা যাও ঘরে।
বাপের আগে জানাও খবর মায়ের গোচরে॥
ভাইয়ের আগে জানাও খবর আর না কিছু চাই।
জলেতে ডুবিয়া মরি অন্য উপায় নাই।
সংসারে নাই মোর বাপ মাও ভাই॥

অঘুর[১২] জলে ঘর বান্ধিম সংসারে কি আশা।
কারে বা দিবাম আমার কপাল সর্ব্বনাশা॥
মায়ে করিলা বনবাসী ঝিরে দিলা জলে।
সুখে থাকুক সতীনা মা তোমরা সকলে॥
আজ হইতে পায়ের কাঁটা দূরত হইল।
সতীনের বংশ শেষ জঞ্জাল ঘুচিল॥

শুন শুন ধাই দাসী জানাই তোমরারে।
এক কথা কইও আমার বাপের গোচরে॥
আমার অভাগী মাও যদি ফিরে ঘরে।
আমার মরণ কথা না জানাইও তারে॥
আর কথা শুন ধাই জানাই তোমরারে।
সাজনের যতেক দর্ব্ব জোড়মন্দির ঘরে॥
সেই সব তোমরা যতনে লইও।
অভাগী জীরার কথা মনেতে রাখিও॥
কন্যার সমান কইরা পালিলা আমারে।
মায়ের মতন ধাই জানতাম তোমরারে॥
ঢেউয়েতে ভাসিছে কন্যার লম্বা মাথার চুল।
পাড়ে থাক্যা ধাই দাসী কান্দিয়া আকুল॥(১—৪৭)


(১০)

* * * *

থালের মধ্যে বাড়া ভাত ভিঙ্গারে রইছে পানি।
ভোজন লাগিয়া আইস মাও জীরালনী॥

* * * *

“মাও হইয়া শাশুড়ী হইলা কোন বা লাজে নিতে আইলা 
মনের নাও পবনের বৈঠা ডুবরে ডুব”
“থালে ভাত ভিঙ্গারে পানি
আইস আইস কন্যা জীরালনী।”
“বাপ হইয়া শ্বশুর হইলা
কোন বা লাজে নিতে আইলা গো।
ওরে মনের নাও।
পবনের বৈঠা বাইয়া পাতালপুরে যাও॥

কোন্ জনে দেখাইমু মুখ, মুখে মাখলাম কালী
ওরে পবনের নাও।
অভাগী জীরারে লইয়া পাতালপুরে যাও॥
যুদি আসে অভাগী মাও কইও তারি কাছে।
তোমার না জীরালনী পাতালপুরে আছে॥”
“থালে ভাত ভিঙ্গারে পানি আমার মাথা খাও।
শুন ভইন জীরালনী মোরে না ভাড়াও॥”
“ভাই হইয়া সুয়ামী হইলা।
কোন্ বা লাজে নিতে রে আইলা রে॥
ওরে মনের নাও।
এই মুখ দেখিবার আগে পাতালপুরে যাও॥
পবনে বৈঠা কন্যা ফালাইল দূরে!
ঝলকে উঠিয়া পানি মনের নাও বুরে[১৩]
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাইঙ্গা পড়ে নদী যে পাগেলা।
ডুবিল সুন্দর কন্যা সোণার পুতুলা॥
মাও গেল বনবাসে কন্যা ডুবে জলে।
গাঙ্গের ঘাটে নাইসে লোক আপ যারে বলে।(১—২৬)

(১১)

চক্রধর রাজার কথা এইখানে থুইয়া।
কি হইল রাজার না মাইয়ার শুন মন দিয়া॥
ভাটি-বাঁকেরে আরে ভাটি-বাঁকে।
হায় ভাটি-বাঁকে বইসে ভালা জাল্যা আর জাল্যানি।
ঝিনাইর মুক্তা লইয়া তারা করে বেচাকিনি॥
জাল বাও জালিয়া ভাইরে শুন বিবারণ।
সদাগর-পুত্র আইল মুক্তার কারণ॥
ভাইট্টাল বাঁকে চাঁদ ডিঙ্গা উজান বাঁকে ঘর।
কোন্ দিকে তোমার বাড়ি কহত উত্তর॥
নদীর না উজান বাঁকে বসতি আমার।
উঁচা উঁচা কলাগাছ কহি চিহ্নি তার॥
এই কথা শুনিয়া লোক সাধুরে কহিল।
শুনিয়া সাধুর পুত্র ত্বরিতি আইল॥
সেরেতে মাপিয়া মুক্তা লইল ভারিয়া।
হেনকালে দেখে সাধু নজর করিয়া॥
ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘর খানি পাতালতার ছানি।
তার মধ্যে বসত করে জাল্যা আর জাল্যানী॥

সাধু বলে জাল্যা তোমার সংসারে কে আছে।
পুত্র কন্যা থাকে যদি আন মোর কাছে॥
কিছু কিছু মেওয়া আমি দেহি ত তাদেরে।
জাল্যা কহে পুত্র বিধি না দিল আমারে॥
সাধু কহে পত্যয় না করি তোমার কথা।
ভাঙ্গা ঘরে চান্দের আলো দিয়াছে বিধাতা॥
তবেত জাল্যানী কাইন্দা কহিতে লাগিল।
নিশি রাইতে জালে বন্দী যে ধন পাইল॥

রাজার কুমারী কিবা দেবের দুলালী।
জীরা জীরা বল্যা ডাকে ঘন ঘন বুলি॥
এক কন্যা দিলা বিধি মোরে আচম্বিতে।
এক খানি তেনা নাইগো গায়ে তুল্যা দিতে॥
দিনমানে মুইটা[১৪] ভাত খাইতে নাই সে পাই।
রাজার দুলালী লইয়া বড় দুঃখ পাই॥
কি কব মায়ের রূপ দেবের দুর্লভ।
এক মুখে কত কইবাম রূপের গৈরব॥
কড়ার তৈল ঘরে নাই মোর কেশেতে মাখিব।
এক খানি গয়না নাই অঙ্গে জুড়িয়া দিব।
আহুকা(?) দৈব্যতি(?) নাইরে মুখে তুইল্যা দিব॥
বড় দুঃখে ঘরে আছে আমার গুণের ঝি।
মুখে নাই রাও চাও আর কব কি॥
তাহার গুণের কথা কইতে নাইসে পারি।
উপাসে ঝুরিয়া মরে তবু মুখে হাসি॥
গির কার্য্য করে কন্যা আমরা থাকি জালে।
রান্ধিয়া ক্ষুদের অন্ন রাখে সর্ব্বকালে॥
শীতের বাতাসে কন্যা অঙ্গে ছেঁড়া বাস।
তবু না মৈলান কন্যার মুখে মিষ্ট হাস॥
বার্ষ্যাতে পাতার ঘর উছিলাতে[১৫] ভাসে।
চিত্তি সুখে থাকে কন্যা দুঃখে নাইসে বাসে॥
মশার কামড়ে তার সর্ব্ব অঙ্গে চাকা।
দায় হইল হেন কন্যা ভাঙ্গা ঘরে রাখা॥
ভাগ্যগুণে ভাগ্যা লক্ষ্মী ঘরেতে আইল।
দুঃখিনী জানিয়া মায় স্মরণ করিল॥

এতেক বলিয়া কান্দে জাল্যা আর জাল্যানী।
দুই নয়ানে ভাসিয়া পড়ে উছিলার পানি॥
সাধু পুত্র কয় জাল্যা না কান্দিও আর।
কন্যা দিয়া ধন লও মনে যা তোমার॥

এই কথা শুনিয়া জাল্যানী জুড়িলা ক্রন্দনে।
লক্ষ্মীরে ছাড়িয়া ঘরে থাকিব কেমনে॥
অপুত্রার পুত্র মাও মোর নির্ধনিয়ার ধন।
ভাঙ্গা ঘরে চান্দের আলো শুন মহাজন॥
এ ধন ছাড়িয়া মোরা ধন নাইসে চাই।
জুড়িয়া বেড়িয়া থাকুক করুন গোঁসাই॥
আর যত যত দুঃখ কপালেতে আছে।
সকল পাইয়া যেন মোর এই ধন বাঁচে॥
জাল বাহিয়া আইয়া যখন মাও সে বইল্যা ডাকি।
বেগার মেন্নতের[১৬] কথা ভুলি চান্দ মুখ দেখি॥
সাঞ্ঝ্যা কালে বাতি দিতে কেউ নাই মোর ঘরে।
রান্ধিয়া ক্ষুদের অন্ন কেবান দিব পাতে।
মাছের ঝাপানি মোর কেবা দিব মাথে॥
আর ধনে কার্য্য নাই মোর এই ধন চাই।
জুড়িয়া বেড়িয়া থাউক করুন গোঁসাই॥
চৌদ্দ ডিঙ্গা ধনের লোভ তাহারে পাশুরী।
জালিয়া তুলিয়া হাতে লইল জালের দড়ী॥

জাল্যানী কয় শুন শুন ধার্মিক সুজন।
বিধাতা দিয়াছে দুঃখ ছাড়াইব কেমুন॥
দুঃখের সহিত দিছে এহি মোর সুখ।
ঘুম তনে উঠিয়া দেখি আমার মায়ের মুখ॥

এই সুখ ধনে বেচি দুঃখ হবে সারা[১৭]
খসিবে হাতের শঙ্খ পতি যাবে মারা॥
মুক্তা লইয়া ঘরে যাহ সাধু মহাজন।
কন্যারে বদলি দিয়া না লইব ধন॥

* * * *

মায়ের গলা ধইরা জীরা কান্দিতে লাগিল।
শুন গো জাল্যানী মাও আমার যে কথা॥
বড় দুঃখে আছ তোমরা গো খাইতে নাই সে পাও।
রাত্র দিবা জাল বাইয়া মিছা দুঃখ পাও॥
আমারে বিকাইয়া লহ এক ডিঙ্গা ধন।
দারিদ্র্য ঘুচিবে মাও থাকিবা সুখেতে।
জীবন ভরিয়া দুঃখ ভুঞ্জিবা কি মতে॥

জাল্যানী কাইন্দা কহে মাও ফাঁকি দিতে চাও।
বেরথায় ধনের লোভে মোদেরে ভাঁড়াও॥

জীরা (সাধুর প্রতি)

শুন শুন সাধুর পুত্র কহি যে তোমারে।
ডিঙ্গা ধন দিয়া তুমি কি লও মোরে॥
আমার না বাপ মাও বড় দুঃখ পায়।
উপাসে কাবাসে, মায়ের দুঃখে দিন যায়॥
ভাঙ্গা ঘর বাইন্ধা দিবা উলুছনে ছানি।
পুব পাহাড়ের শালঠা কাঠে দিয়া তার ঠুনি[১৮]

ঘর ভরিয়া দেহ নানা ধন দিয়া।
তবে ত আমারে তুমি যাইবা লইয়া॥

কিন্তু এক কথা মোর শুন মহাজন।
কন্যা কহে সাধু তুমি ধার্ম্মিক সুজন॥
পরপুরুষ তুমি আমি যুব্বামতী।
কেমনে রহিবাম কাছে হইয়া যৈবতী॥
অবিচার নাই সে কর ধর্ম্মের দোহাই।
একেলা বঞ্চিব ঘরে দুসর না চাই॥
পাতের অম্ল না খাইব পিরথক শয়নে।
থাকিব তোমার ঘরে এহিত[১৯] বসনে॥
তৈল না মাখিব কেশে না করিব ছান।
মাটিতে শুইব আমার আইঞ্চল বিছান।
খাইব ক্ষুদের অন্ন আলবনী[২০] হইয়া।
আমার অমতে মোরে না করিবা বিয়া॥
একত পরতিজ্ঞা মোর শুন মহাজন।
পরতিজ্ঞা পূরণ হইলে বিয়ার কথন॥(১—১১০)

* * * *


(১২)

কন্যা লইয়া যায় সাধু তের নদী বাইয়া।
জাল্যা আর জাল্যানী কান্দে জোড়মন্দিরে রইয়া॥
আবের ছানী জোড় না মন্দির হইল অন্ধকার।
মাথা থাপাইয়া কান্দে করে হাহাকার॥

হেথায় হইল কিবা শুন দিয়া মন।
ছয় মাসে গেল সাধু আপন ভবন॥
রতন মন্দিরে কন্যায় যতনে রাখিল।
যেমতি কহিল কন্যা সেমতি রহিল॥

এক দিন কহে কথা সাধুর নন্দন।
কহ কহ কন্যা শুনি পূর্ব্ব বিবারণ॥
কান্দিয়া কান্দিয়া কন্যা সকলি কহিল।
সোনার হরিণ কথা গোপন রাখিল॥
কন্যা কহে শুন শুন সাধুর নন্দন।
মাও মোর কোন বনে করে বিচরণ॥
খবইরা পাঠাইয়া তুমি এহি খবর লও।
আর এক কথা মোর শুন মহাজন।
সংসার ভরমিয়া দেখি আশ্চর্য্য ঘটন॥
একদিন ধাই মোরে গল্পে শুনাইল।
এক দেশের রাজপুত্র হরিণ হইল॥
বিমাতা কুচক্রী হইয়া শিরে বাইন্ধে টুকি।
মানুষ হরিণা ছিল জঙ্গলাতে থাকি॥
কোন দেশের রাজা দেখ শীকারেতে গেল।
সেইত সোনার হরিণ বান্ধিয়া রাখিল॥
ধরিয়া বান্ধিয়া রাখে বন্দি শালা ঘরে।
এই মত থাকে হরিণ কিছু দিন পরে॥
কি মতে মানুষ হইল কিছুই না জানি।
সত্যমিথ্যা কথা তুমি জানহ আপনি॥
এই দুই সমাচার মোরে আন্যা দাও।
পশ্চাৎ বিয়ার কথা শুন মহাশয়॥
আর কথা শুন সাধু কহি যে তোমারে।
একেলা না রইব আমি তোমার না ঘরে॥

সঙ্গে ত করিয়া মোরে লইবা মহামতি।
তোমার চরণে আমার এতেক মিন্নতি॥

তবেত সাধুর পুত্র কোন্ কাম করে।
চৌদ্দখান ডিঙ্গা সাধু সাজায় সত্বরে॥
চৌদ্দ ডিঙ্গার মাস্তুল খাড়া উড়াইল পাল।
বাইছা গণে[২১] ডাক্যা কয় সাধু করহ সামাল॥
বেবান[২২] সায়রে ডিঙ্গা যখনে পড়িল।
পূবের নাবায়[২৩] মেঘা গৰ্জ্জিয়া উঠিল॥
বাইছা গণে কহে সাধু না কর গমন।
আজিকার আসমানে দেখি কুলক্ষণ॥(১—৩৪)

(১৩)

সুবুদ্ধি সাধুর পুত্র কুবুদ্ধি হইল।
ডিঙ্গা বাইতে মাঝি মাল্লায় হুকুম করিল॥
সাজ্যা আইল বার দেওয়া[২৪] ঘন ঘন ডাকে।
বান পাথালে পড়ে চৌদ্দ ডিঙ্গা পাকে॥
ঘুরিতে ঘুরিতে ডিঙ্গা বেসামাল হইল।
পর্ব্বত পরমান ঢেউ গৰ্জ্জিয়া উঠিল॥
ঝিনাই[২৫] হেন ভাসে ডিঙ্গা করে টলমল।
একে একে চৌদ্দ ডিঙ্গা করে উভে হইল তল॥

ভাসিল সাধুর পুত্র ঢেউয়ের উপরে।
আরবার রাজার কন্যা ভাসিল সাওরে॥
কপালের দুঃখ দেখ না যায় খণ্ডন।
পরেত হইল কিবা শুন সভাজন॥(১—১২)

(অসমাপ্ত)

  1. গুণ কহি তার ঠাট=তাঁহার গুণ ও ঠাটের (ক্ষমতা-প্রতিপত্তির) কথা কহিতেছি।
  2. মধুমল্লার পুরী=মধুমালা প্রাচীন প্রবাদের পরী। এই পরীর উল্লেখ চৈতন্য-ভাগবতের আদিখণ্ডে আছে।
  3. গোটা=একটি।
  4. নিউলিয়া=নিরীক্ষণ করিয়া।
  5. সেজুতিয়া=সন্ধ্যার।
  6. আছান=সান্ত্বনা।
  7. গুমুর=গোপন।
  8. মেলা দিল=যাত্রা করিল।
  9. না ভাইব দুষ্মন=আমাদিগকে শত্রু বলিয়া ভাবিও না।
  10. মনের=মনপবন নামক কাঠের।
  11. তুরুঙ্গ=তরঙ্গ।
  12. অঘুর=ঘোরতর; এখানে “অ” অক্ষরের অর্থ বিপরীত। লৌকিক ভাষায় এইরূপ বিপরীত অর্থ মাঝে মাঝে দেখা যায় যথা—“তোমার চেষ্টা অবৃথা যাইবে না” এখানে অন্বথা অর্থ বৃথা।
  13. বুরে=ডুবিয়া যায়।
  14. মুইটা=মুষ্টি।
  15. উছিলা=বন্যা।
  16. বেগার মেন্নত=লাভশূন্য খাটুনি।
  17. এই সুখ···সারা=ধনের লোভে এই সুখ বিক্রয় করিয়া দুঃখে সারা হইবে।
  18. পূব···ঠুনি=পূর্ব্বদিকের পাহাড় হইতে শাল্টি (শলি) কাঠ আনাইয়া তাহা দিয়া থাম (ঠুনি) তৈরী করিয়া দিবে।
  19. এহিত=এই যে কাপড় পরিয়াই আছি তাহা পরিয়াই থাকিব।
  20. আলবনী=লবণ-শূন্য।
  21. বাইছা গণে=নৌকাবাহকগণকে, মাঝিদিগকে।
  22. বেবান=দুর্লঙ্ঘ্য।
  23. পূবের নাবায়=পূব আকাশের নিম্নভাগে।
  24. বার দেওয়া=নানা পুস্তকে নানারূপ মেঘের কথা আছে, পুষ্কর, আবর্ত্ত, সম্বর প্রভৃতি মেঘের নাম সংস্কৃতে পাওয়া যায়। এখানে যে বার মেঘের উল্লেখ আছে, তাহারা কি কি?
  25. ঝিনাই=ঝিনুক।